মুখ থাকলেই খুলতে হয় না

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

ফেসবুকের অকল্পনীয় বিস্তার দেখে অনেকে ভেবেছিল, হ্যাঁ, এত দিনে একটা কাজের কাজ হয়েছে। এইবার জুতমতো গণতন্ত্রচর্চা করা যাবে। ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের চোটে এইবার জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার চালিত হবে। এইবার পাবলিক মুখ খুলবে। শাসকেরা পাবলিকের কথা না শুনে আর পারবে না। 

মুখ থাকলেই খুলতে হয় না, খুললেও কোথায় কতটুকু খোলা উচিত—পাবলিকের সেই বোধ কম। অন্যদিকে, পাবলিকের মুখ কতটুকু বন্ধ রাখলে সেটিকে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা বলে না, সেই বোধও ক্ষমতাসীনদের নেই। এক পক্ষ বলার নামে যাচ্ছেতাই বলতে চাইছে, অন্য পক্ষ ‘চোপরাও!’ বলে কিছুই বলতে দিতে চাইছে না। ডিজিটাল আইনের সাঁড়াশি নেটিজেনদের ঘাড়ের ওপর বসানো আছে। সেই সাঁড়াশি দিয়ে বলা যায় যে কাউকে ক্যাঁক করে ধরে ফেলা যাচ্ছে। 

বাস্তবতা হলো, এত দিনেও অসামাজিক কার্যকলাপমুক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গড়ে তোলা যায়নি। একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। একটার পর একটা ইস্যু আসছে আর ফেসবুক গরম হচ্ছে। একের পর এক ইস্যুতে নেটিজেনরা তর্কাতর্কি চালিয়ে যাচ্ছে। আলাপ গড়াচ্ছে প্রলাপে। একদল চ্যাঁচাচ্ছে। সেই চ্যাঁচানি স্তব্ধ করতে আরেক দল আরও বড় চ্যাঁচানি দিচ্ছে। চ্যাঁচাচেঁচি একপর্যায়ে ছ্যাঁচাছেঁচিতে গড়াচ্ছে। স্ট্যাটাস দেওয়া নিয়ে পিটিয়ে মানুষ মারার ঘটনাও ঘটছে। সেই ঘটনা নতুন নেট-যুদ্ধ লাগিয়ে দিচ্ছে। 

বরগুনায় রিফাত হত্যা হলো। প্রতিবাদ শুরু হলো। প্রতিবাদ ছাপিয়ে চেঁচামেচি শুরু হলো। রিফাতের স্ত্রী মিন্নি খুনি নাকি নির্দোষ, তা নিয়ে দুই পক্ষের যুদ্ধ বাধল। সেই চেঁচামেচি শেষ না হতেই নতুন চেঁচামেচি আমদানি করল প্রিয়া সাহার ট্রাম্পদর্শন। আবার দুই পক্ষের কাজিয়া বাধল। এরপর কল্লাকাটা আতঙ্কে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে পিটিয়ে মারা নিয়ে ফেসবুক গরম হলো। এরপর ডেঙ্গু, তারপর ভিসি–কাণ্ড, তারপর পেঁয়াজ, তারপর ফেনী নদীর পানি এবং তারপর আবরার ইস্যু। আবরার ইস্যু ধরে এখন শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নিয়ে তর্ক চলছে। এক পক্ষ বলছে, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা দরকার। আরেক পক্ষ বলছে, ‘কাভি নেহি’। পাবলিকের এই ধরনের কামড়াকামড়িকে স্বাগত জানিয়ে চিরকালই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’পন্থী ক্ষমতাসীনেরা ভেবে এসেছে ‘অল ইজ ওয়েল!’ 

পাবলিক ঝগড়াপ্রিয়। লাগাতার কুৎসা ছড়ানো বা হুমকি দেওয়ার এমন মোক্ষম অস্ত্র তার হাতে এর আগে কোনো দিন আসেনি। এই কারণে নেট-সংঘর্ষ এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হচ্ছে না। 

তর্ক ভালো। তর্ক বহু পথ খুলে দেয়। কিন্তু ফেসবুকে সমকালীন ইস্যু ধরে কুকথার নীচতা ও কদাচারের সূচক শেয়ারবাজারের সূচকের চেয়ে দ্রুত নিম্নগামী হচ্ছে। প্রতিদিন পতনে নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। কাউকে ‘সাইজ’ করতে এখন আর রাস্তায় নেমে গা ঘামাতে হচ্ছে না। নিরিবিলি পরিবেশে বিছানায় শুয়ে বাছা বাছা শব্দাস্ত্র ছুড়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছে। 

সামনাসামনি কাউকে কুকথা বললে তার শ্রোতা বড়জোর আট–দশজন হতে পারে। কিন্তু ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাছা বাছা কয়েকটা খিস্তি দিতে পারলেই হয়ে গেল। ভাগাড়ের মরা গরু দেখে ছুটে আসা শকুনের ঝাঁকের মতো লাইক, কমেন্ট নিয়ে শতসহস্র দর্শক-শ্রোতা ছুটে আসবে। বৈঠক গরম হয়ে যাবে। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবমাননা, হুমকি, নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে আইন আছে, তা মানার লোক কম—এই কথা ঠিক। আবার সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে এই আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না—এ কথাও সত্য। এই বৈষম্যমূলক আচরণ নেটিজেনদের অসহিষ্ণু করে তুলছে। এই বৈষম্যের কারণেই দেশের বাইরে অবস্থান করা লোকেরা এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে গিয়ে ভাষাগত পরিমিতি বজায় রাখছেন না। 

গণতন্ত্রে বহুমত প্রত্যাশিত। বিতর্ক ও প্রতিবাদ স্বাগত। কিন্তু সেটা ততক্ষণই, যতক্ষণ সেই মত বা দ্বিমতের কিছুমাত্র সারবত্তা থাকে। মতপ্রকাশের অধিকার আছে বলেই যুক্তিবুদ্ধি ও রুচিবোধ ছুড়ে ফেলে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই প্রকাশ করার অনুশীলন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেলেই বিপদ। বিপদের কথা হলো, আমরা সেই বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো মতামত দিলে বা মন্তব্য করলে, তা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে যদি তর্কের বীজ থাকে, বিভেদ-বিদ্বেষের স্ফুলিঙ্গ থাকে, তাহলে আগুন ধরতে সময় লাগে না। বিপদের কথা হলো, অনেকেই সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা না করে বরং তা থেকেই মনের আনন্দে বিড়ি ধরিয়ে খায়। 

অতিকথনে ক্ষতি আগেও ছিল, এখনো আছে। ফেসবুকে অতিকথনে, ক্ষেত্রবিশেষে শুধু কথনেও ক্ষতির মাত্রা আরও গুরুতর হতে পারে। 

নানা ধরনের মানুষের নানা ভাবনা তুলে ধরার যে সুযোগ ফেসবুক তৈরি করে দিয়েছে, বেহুদা কথার তোড়ে তা এখন ভেসে যাচ্ছে। গ্রেশামের থিওরি বলে, খারাপ টাকার ফালাফালিতে ভালো টাকা সটকে পড়ে। সেই কায়দায় ফেসবুকে আলতু–ফালতু কথার দাপটে কাজের কথারা টিকতে পারছে না। নীরবে সটকে পড়ছে। কেউ কাজের কথা তুললে বা গুরুতর কোনো আলোচনার সূত্রপাত করলে প্রায়ই ফালতু মন্তব্য, টিপ্পনী, এমনকি গালিগালাজ হু হু করে আসছে। মতপার্থক্য ব্যক্তিগত আক্রমণে রূপ নিচ্ছে। যার সত্যিই কিছু বলার ছিল, সে ভদ্রলোকের মতো চুপ মেরে সরে যাচ্ছে। ফেসবুক থেকে সাধু বাক্য ক্রমাগত সরে যাচ্ছে, ফালতু বাক্য ভাইরাল হচ্ছে—এ তো মারাত্মক বিপদের কথা! 

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক