অবিলম্বে লেজুড়বৃত্তির অবসান চাই

ইকবাল হাবিব
ইকবাল হাবিব
>ইকবাল হাবিব, নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি। বুয়েট পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।

প্রথম আলো: বুয়েটের ইতিহাসে একজন উপাচার্য (১৯৯১–৯৬) দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে অপসারিত, আরেকজন উপাচার্য (২০১০–১৪) দুর্নীতি ও দলীয়করণের দায়ে ছাত্র আন্দোলনের কবলে পড়েছেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে আরও একজন উপাচার্য বিতর্কের মুখে পড়লেন। 

ইকবাল হাবিব: আগের দুই পর্বে দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা বুয়েটের ঐতিহ্যগত নীতি অনুযায়ী পরিচালনায় ব্যর্থতার বিষয়টি সামনে এসেছিল। এবারের পর্বটি একেবারে ভিন্ন। এবার আমরা জানলাম, বছরের পর বছর ধরে পরমতসহিষ্ণুতা এবং ভিন্নমতকে দমন করা হচ্ছে। আবরার ফাহাদও তার শিকার হয়েছে। ১০৩টি অভিযোগ সার্ভারে জমা পড়েছে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা কত, তা আমরা জানি না। তাই অতীতে বুয়েটে কী হয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস। আমরা এখন ঠাস ঠাস শব্দ শুনছি। আগে দুই উপাচার্যের আমলে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল, সেই পরম্পরায় বুয়েট পতনের দিকে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। বর্তমান উপাচার্যের আগে প্রধানমন্ত্রীর ছোটবেলাকার বন্ধু উপাচার্য ছিলেন। তিনি তো দলনির্বিশেষে একটা প্রশাসনিক দক্ষতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট করেছিলেন, লেজুড়বৃত্তির মধ্য দিয়ে ছাত্রকল্যাণ হয় না। আজ যে ধস নেমেছে, সে জন্য দায়ী একটি মেরুদণ্ডহীন প্রশাসন। যদিও প্রধানমন্ত্রী রাব্বানীদের সরাসরি খারিজ করেছেন। কিন্তু তার আধা কিলোমিটার দূরে সেটা কোনো বার্তা বয়ে আনেনি। কারণটা হচ্ছে, দলীয় মদদপুষ্টরা ধরেই নিয়েছে যে এটা ক্ষণিকের ব্যাপার। ঘটনা একটু আড়াল হলেই পুনরায় যা খুশি তা–ই করা যাবে। একটি দানবীয় মেশিন তৈরি হয়ে গেছে, তাদের কাছে বার্তা পৌঁছাচ্ছে না। ছাত্রশিবিরের নামে কাউকে লাঞ্ছিত করার মতো প্রণোদনা দলের ভেতর থেকে একশ্রেণির মানুষ দিচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে হলে হলে নির্যাতন চলছে, পিটিয়ে কানের পর্দা ফাটানো, হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিকারে সংশ্লিষ্টদের কাউকে আমরা উতলা হতে দেখিনি। এই দুর্বৃত্তায়ন এক দিনে ঘটেনি। তবে অতীতের যেকোনো খারাপ পরিস্থিতির সঙ্গে এবারের অবস্থাটিকে আমি মেলাতে চাই না। এটা ভয়াবহ। 

প্রথম আলো: কিন্তু উপাচার্যের পদত্যাগেই যদি বেশি জোর দেন, তাহলে দুর্বৃত্তায়নের মূল কারণগুলো আড়ালে পড়তে পারে।

ইকবাল হাবিব: আমরা প্রাক্তনরা ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে। আমরা কিন্তু প্রথমে কয়েক ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা করেছি। এবং বুঝেছি যে বুয়েটে একটি বিষবৃক্ষ তৈরি হয়েছে। এর মূলোৎপাটন দরকার। এটা শুধু ভিসির কথা নয়, এই সীমাহীন নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি এবং মেরুদণ্ডহীন প্রশাসনের সবাইকে একটা জবাবদিহির মধ্যে আনার জায়গা থেকে আমরা কথা বলেছি। এ বিষয়ে যাঁরা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পদে যে যেখানে আছেন, তাঁদের যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। আমাদের এই অবস্থানের অনুরণনে প্রধানমন্ত্রীকেও আমরা দেখেছি, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কারা, তারা কী করছিল, কীভাবে করছিল। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এই চেতনার জায়গার সঙ্গে আমাদের অভিব্যক্তির একটা অন্ত্যমিল রয়েছে। যারা এক যুগের একটা মেধাবী বিনম্র শিক্ষাজীবন পার করল। তারা মাত্র এক থেকে দুই বছরের মধ্যে বুয়েটজীবনে কী করে দানবীয় হতে পারল। 

প্রথম আলো: অনেকে মনে করেন, এমনটা হওয়ার অন্যতম মূল কারণ রুগ্‌ণ জাতীয় রাজনীতি। আপনি যে মেশিনের কথা বলছেন, তার চালকেরা আছেন ক্যাম্পাসের বাইরে। এই মেশিন বন্ধে আপনি ক্ষমতাসীন দলের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন দেখছেন? 

ইকবাল হাবিব: আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলেছি, রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করাটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বছরের পর বছর চলছে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। বুয়েট ছিল গানে–বিতর্কে–সংস্কৃতিতে নিজেকে তৈরি করার মেশিন। যেখান থেকে জামিলুর রেজা চৌধুরী ও আবুল হায়াতের মতো মানুষ আমরা পেলাম। সেই বুয়েটে একটা সরকারি ও প্রশাসনিক মদদপুষ্ট লেজুড়বৃত্তির সংস্কৃতি একটি মহলকে একচ্ছত্র আধিপত্য দিল। তারা সেটা প্রয়োগ করল। তখন তার কী পরিণতি হতে পারে, সেটা আমরা দেখলাম। সুতরাং আমরা এসব জায়গায় হাত দিতে বলেছি। আমরা বলেছি, এই জায়গায় কারা কারা প্রচ্ছন্নভাবে ছাত্রদের প্রণোদিত করে বিপথগামী করেছে? কী কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা প্রণোদিত হয়েছে, সেটা দলগুলোর এখন খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ, এই সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই হত্যাকারী তৈরি হচ্ছে। সে কারণে আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা তাঁর প্রশংসা করছি। কারণ, এই জায়গাগুলোকে পরিশীলিত করা এবং নতুন করে পরিবীক্ষণের বিষয়টি সবার চেতনার মধ্যে নেওয়া উচিত। ১৯ জনকে বহিষ্কার করার মধ্য দিয়ে বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন হবে না। এই জায়গায় মনোনিবেশ করাটাই আমাদের এখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

প্রথম আলো: বুয়েট তো খুব বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি একই ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে। অনেকে বলেন,
এখন দলগুলো নয়, দলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটা কি বাস্তবতা?

ইকবাল হাবিব: আমি স্পষ্ট বলতে চাই, যে রাজনীতির চেতনা এখন আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি, সেটা হলো, একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জবাবদিহির মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী মানসিকতায় রাজনীতি করা যাবে না। ক্যাম্পাসে পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

প্রথম আলো: ক্ষমতাসীন দল যদি আজ তার অঙ্গ ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত বা বন্ধ করে, তাহলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না। শিক্ষকেরা প্রথমে আপাতত বন্ধ থাকা চেয়েছিলেন। আপনি কি চান সেটা নির্দিষ্ট করা সম্ভব?

ইকবাল হাবিব: হ্যাঁ। আমি স্পষ্ট করে বলছি, এই বিষয়ে সবার আগে ক্ষমতাসীন দলকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। প্রজ্ঞা ও জ্ঞানভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করতে হবে। ইউকসু, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। ছাত্ররাজনীতিকে হ্যাঁ, কিন্তু লেজুড়বৃত্তির ছাত্রসংগঠনকে না।

প্রথম আলো: পরিষ্কার হলো না। আপনি নির্দিষ্টভাবে বলুন, মূল দলের সঙ্গে বুয়েট ছাত্রলীগের সম্পর্ক কী হবে? 

ইকবাল হাবিব: অবিলম্বে লেজুড়বৃত্তির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের অবসান দরকার। আপনি ইউকসু নির্বাচন করবেন না, একটা জবাবদিহিহীন পরিবেশে লেজুড়বৃত্তির সংগঠন চালাবেন, এটা কাম্য হতে পারে না। মূল দলের কাছেই তো এটা কাম্য হতে পারে না। কেউ টর্চার সেল চাইতে পারে না। নিষ্ক্রিয় কথাটা আমি ব্যবহার করতে চাই না। কারণ, তাতে ছাত্ররাজনীতি নিষ্ক্রিয় হতে পারে, সেটা চাই না। একটা উদাহরণ দিই। বুয়েটের স্থাপত্য অনুষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হচ্ছে। হল সংসদ যদি আজ নির্বাচিত হতো, তাহলে হলে হলে টর্চার সেল তৈরির সুযোগই তৈরি হতো না। আমি চাই, ইউকসুর মতো নির্বাচিত কাঠামো কার্যকর হওয়ার আগপর্যন্ত লেজুড়বৃত্তির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত থাকুক।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ইকবাল হাবিব: ধন্যবাদ।