আপনি সম্ভবত অপুষ্টিতে ভুগছেন

‘অপুষ্টি’ শব্দটি শুনলেই তীব্র খরাজনিত দুর্ভিক্ষের মুখে পড়া এলাকার কিংবা যুদ্ধকবলিত এলাকা থেকে পালিয়ে আসা অথবা শরণার্থীশিবিরে দিনের পর দিন না খেয়ে মরতে বসা শিশুদের চিত্রকল্প চোখে ভেসে ওঠে। এই ছবি বা চিত্রকল্প অবশ্যই ক্ষুধার প্রতিবিম্ব, কিন্তু শুধু এসব জায়গাতেই মানুষ অপুষ্টির শিকার হচ্ছে, বিষয়টি মোটেও তা নয়। এই বিশ্বে বর্তমানে ৮২ কোটির বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এদের বেশির ভাগের বাস এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। পুষ্টিহীনতা এখানকার এমন এক কঠিন সমস্যা, লাগাতার চেষ্টাতেও যার কাঠিন্যে চিড় ধরানো যাচ্ছে না।

পুষ্টিহীনতা বলতে আমরা যা বুঝি, তার বাইরেও ছায়াশ্বাপদের মতো আমাদের মধ্যে অদৃশ্য পুষ্টিহীনতা আছে এবং আপনি হয়তো ভাবতেও পারছেন না যে আপনার ঘরেই তা ঘাপটি মেরে আছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নারী-পুরুষের কোমরের পরিধি বেড়েছে এবং বর্তমানে বিশ্বে ২০০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তাঁদের মধ্যে ৬৭ কোটি লোক স্থূলতায় ভুগছেন। এর বাইরে ১২ কোটি শিশু–কিশোরও স্থূলতার শিকার হয়ে আছে।

আমরা কতটুকু পুষ্টি পাই, অবশ্যই আমাদের প্রতিদিনকার খাবারই তা নির্ধারণ করে। তবে অপুষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য খাবারের পরিমাণ বড় কথা নয়, বরং আমরা কী খাচ্ছি বা না খাচ্ছি, তার ওপরই পুষ্টি-অপুষ্টির বিষয় নির্ধারিত হয়। সোজা কথায়, পুষ্টি বিষয়ে বিশ্ব এখন তিন ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করছে। সেগুলো হলো অপর্যাপ্ত পুষ্টি, ভিটামিন ও খনিজের অভাব এবং স্থূলতা বা মুটিয়ে যাওয়া। ওজন বাড়ার পেছনে অবশ্যই কারণ (এবং অজুহাত) আছে। জীবনযাত্রা ও খাদ্য গ্রহণের ধরন বদলে গেছে। নগরায়ণের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। ফাস্ট ফুডের ওপর উত্তরোত্তর নির্ভরশীলতাও স্থূলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আসলে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় তীব্র মাত্রার শর্করা, লবণ ও চর্বিসমৃদ্ধ জাঙ্কফুড খেতে উৎসাহিত করার জন্য বলা যায় বিজ্ঞাপনের ‘বোমাবর্ষণ’ চলছে। অন্যদিকে বহু মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় ফল, শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবার অনেক কম খেয়ে থাকে। ‘প্রতিদিন একটি আপেল ভক্ষণ ডাক্তারকে দূর রাখে’—মনে হচ্ছে আমরা এই কথা ভুলে গেছি। কম্পিউটার ও স্মার্টফোনের মতো প্রযুক্তির কারণে বিনোদনের সুযোগ এবং কর্মস্থলে আসনাশ্রিত কাজ বেড়েছে। এর ফলে আমাদের শরীর ক্যালরি ক্ষয় করার সুযোগ কম পাচ্ছে এবং এর কারণে শরীরে অতিরিক্ত ক্যালরি জমা হচ্ছে। শরীরে চর্বি জমার এবং দ্রুত মুটিয়ে যাওয়ার এটিই প্রধান কারণ।

অপেক্ষাকৃত ধনী দেশের জনগণ এবং দরিদ্র দেশের ধনী লোকদের এই খাবার গ্রহণে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এমন অনেক লোক আছেন, যাঁরা তাঁদের পারিপার্শ্বিক জাঙ্কফুডের বিকল্প হিসেবে স্বাস্থ্যকর খাবার হাতের কাছে পান না। কোথাও কোথাও ফলমূল ও শাকসবজি পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় না। অনেক জায়গায় এসবের দাম সামর্থ্যের বাইরে থাকায় অনেকে রাস্তার পাশের ভাজাপোড়া খাবার খেয়ে থাকে।

যথার্থ পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ার জন্য আমাদের মানবসম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আসনাশ্রিত জীবযাত্রার মধ্যে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের প্রবণতা এত বেড়ে গেছে যে কায়িক পরিশ্রম না করাজনিত রোগ (যেমন ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও কার্ডিওভাসকুলার রোগ) বেড়ে গেছে। পুষ্টিহীনতা ও অপর্যাপ্ত পুষ্টিজনিত মুটিয়ে যাওয়ার জন্য বহু লোক মারা যাচ্ছে এবং শুধু স্থূলতাজনিত কারণে প্রতিবছর সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের জীবনযাত্রা বদলানোর মধ্যে আমাদের ব্যক্তি ও সামষ্টিক স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।

প্রশ্ন হলো কোত্থেকে এই যাত্রা শুরু করতে হবে এবং কে সেই জীবনযাত্রা পরিবর্তনের অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দেবে?

ব্যক্তিপর্যায় থেকেই এটি শুরু করতে হবে। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে আমাদের ঠিক করতে হবে নিজেকে ঠিক রাখতে হলে কোন খাবার খাওয়া উচিত। সরকার, কৃষকশ্রেণি এবং ব্যক্তি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেয়, এমন নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার খাদ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যতে পারে, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র ও অন্যান্য জায়গায় কম চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবারসমৃদ্ধ ‘স্মার্ট মিল’ চালু করেছে। এতে সেখানকার তরুণ ও যুবকেরা সহজেই তাঁদের স্বাস্থ্যকর খাবারের স্থান খুঁজে পাচ্ছেন। 

ব্যক্তি খাতের খাদ্য প্রস্তুতকারক, খুচরা বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা তাদের খাদ্যপণ্যের পুষ্টিগুণ বাড়াতে উদ্যোগী হলে জনস্বাস্থ্য উন্নত হতে পারে। কৃষকেরা পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ফলমূল, শাকসবজি, বাদাম ইত্যাদি চাষে বৈচিত্র্য আনতে পারেন। এসব চাষে বৈচিত্র্য আনলে কৃষক বেশি লাভবান হবেন, এতে তাঁদের খাদ্যনিরাপত্তা বাড়বে।

বিশ্ব ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের অপুষ্টির অবসান ঘটানোর যে অঙ্গীকার করেছে, তা পূরণ করতে আমাদের সবাইকে যার যার জায়গা থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। প্রতিবছরের মতো আজ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছরের মূল প্রতিপাদ্যে আমাদের স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। এবারের স্লোগান ‘আমাদের পদক্ষেপ, আমাদের ভবিষ্যৎ’। ভবিষ্যৎ আমাদের সামনেই, সুতরাং আসুন কাজে নেমে পড়ি।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুন্দাভি কাদিরেসান জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) একজন সহকারী মহাপরিচালক ও আঞ্চলিক প্রতিনিধি