সমালোচনা ও উপদেশ প্রদানে ইসলামি শিষ্টাচার

ইসলাম সহজ, সাবলীল ও যৌক্তিক। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ, সহাবস্থান ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। সব স্বাধীনতায় রয়েছে সীমারেখা, দায়িত্ব পালনেও রয়েছে বিধিনিষেধ। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে, কথায়, কাজে, আচরণে কখনো ভুলত্রুটি হলে, সংশোধন, উত্তরণের জন্য প্রয়োজন যথাযথ সমালোচনা ও হিতোপদেশ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘কল্যাণ কামনাই ধর্ম।’ (মুসলিম: ২০৫)।

কোনো বিষয়ের ওপর বিশদ তথ্য উপস্থাপন করে তার ভালো–মন্দ পক্ষে ও বিপক্ষে মতপ্রকাশ করাকে আলোচনা বলে। আর গভীর বিশ্লেষণ ও বিষয়ের নেতিবাচক দিক এবং এর নেতিবাচক প্রভাব বর্ণনাকে সমালোচনা বলা হয়। ইসলামে পরনিন্দা, পরচর্চা, অহেতুক সমালোচনা ও অনর্থক তিরস্কার যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি সমাজ-সংস্কৃতি, গণমানুষের স্বার্থ, সর্বজনীন নীতিনৈতিকতা ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সমালোচনাও অনুমোদিত।

শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সত্য কথা বলা, প্রয়োজনে উপদেশ দেওয়া, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা ধর্মীয় কর্তব্যের অংশ। সত্যের প্রতি আহ্বান, সৎ কাজে উৎসাহদান, মন্দ কাজের নিন্দা করা ইমানি দায়িত্ব। নীরবতা যদি সমাজের ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সত্যের পক্ষে কথা বলা ইমানদারের অপরিহার্য কর্তব্য।

এক মুসলিম অপর মুসলিমের অন্যতম অধিকার হচ্ছে যখন সে উপদেশ চাইবে, তখন তাকে উপদেশ দেওয়া। অনেক সময় উপদেশদাতা কথার ভারসাম্য রক্ষা না করে কঠিন রূঢ় শব্দ প্রয়োগ করেন, আঘাত দিয়ে কথা বলেন। স্থান, কাল ও পাত্র নির্বাচনে ভুল করেন। সমালোচনা কখনো এত তীক্ষ্ণ ও তির্যক হয় যাতে কখনো ভদ্র, বিনয়ী মানুষের পক্ষেও তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়। এমন সমালোচনা অনেক ক্ষেত্রেই উপকারের বদলে ক্ষতি করে। ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। এরূপ সমালোচনা ইসলাম সমর্থন করে না।

উপদেশ প্রদানে শিষ্টাচার থাকা দরকার। ইবনে রজব (র.) বলেন, মুসলমানদের প্রতি উপদেশ হচ্ছে নিজের জন্য যা ভালোবাসে তাদের জন্যও তা ভালোবাসা। নিজের জন্য যা অপছন্দ করে তাদের জন্যও তা অপছন্দ করা। তাদের প্রতি দয়াশীল হওয়া, ছোটদের স্নেহ করা, বড়দের শ্রদ্ধা করা। তাদের দুঃখে দুঃখী হওয়া, তাদের খুশিতে আনন্দিত হওয়া; যদিও এতে তার দুনিয়াবি ক্ষতি হয়। আবু আমর ইবনুস সালাহ (র.) বলেন, নসিহত হচ্ছে উপদেশদাতার পক্ষ থেকে উপদেশ গ্রহীতার জন্য কল্যাণ কামনা ও হিত সাধন। (জামিউ উলুমিল হিকাম, পৃষ্ঠা: ৮০)।

উপদেশ বা নসিহত প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা অপরিহার্য। উপদেশ দিতে হবে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার চেতনায়। রূঢ়, কর্কশ ও কঠিন ভাষায় নয়। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়।’ (সূরা-১৬ নাহল, আয়াত: ১২৫)।

প্রকাশ্যে মানুষের সম্মুখে নয়, উপদেশ দিতে হবে ব্যক্তিগতভাবে। সালফে সলিহীন গোপনে সদুপদেশ দিতেন। তাঁরা বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইকে একান্তে উপদেশ দিয়েছে সেটাই নসিহত, আর যে ব্যক্তি মানুষের সামনে সদুপদেশ দিল, সে তাকে ভর্ৎসনাই করল। ফুজাইল (র.) বলেন, ‘ইমানদার লোক দোষ গোপন রাখে ও একান্তে উপদেশ দেয়। আর পাপী লোক মানুষকে অসম্মান করে, ভর্ৎসনা করে ও প্রকাশ্যে লজ্জা দেয়।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম: ২৩৬)।

মনে রাখতে হবে, উপদেশ দানে সর্বোত্তম শব্দ ও সবচেয়ে সুন্দর ভাষা ব্যবহার করা এবং কোমল ও নমনীয়ভাবে উপস্থাপন করা এবং মুসলমানের দোষত্রুটি যথাসাধ্য লুকিয়ে রাখা, সম্মানে আঘাত না করা জরুরি। আলোচনা–সমালোচনায় বা উপদেশ প্রদানে কারও প্রতি অসম্মান, অশ্রদ্ধা, অভক্তি প্রকাশ বা প্রদর্শন এবং এসব উদ্রেকের সহায়ক হওয়া বৃহৎ পাপের কারণ। বিকৃত সমালোচনা এবং ভুলভাবে উপদেশ প্রদান সমস্যা সমাধান করে না, বরং আরও বৃদ্ধি করে। সর্বোপরি সমালোচক পূর্বাপর সব পাপের ভাগীদার হন।

আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনুমান হতে বেঁচে থাকো, নিশ্চয়ই ধারণা করা অনেক ক্ষেত্রেই পাপ; আর তোমরা অন্যের গোপন বিষয় সন্ধান কোরো না এবং পরের পশ্চাতে নিন্দা কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তা ঘৃণাই করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, অাল্লাহ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১২)।

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]