ভারত-বাংলাদেশ সমঝোতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরকালে সাতটি চুক্তি/সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সাতটির মধ্যে তিনটি চুক্তি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে দেশে কিছু ক্ষোভ, কিছু সমালোচনাসহ। এগুলোর মধ্যে ত্রিপুরার সাবরুম শহরের জন্য ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার নিয়েই ক্ষোভ বেশি দেখা গেছে। এ পানির পরিমাণ খুব বেশি নয় আর ত্রিপুরার মানুষের প্রতি আমাদের শুভকামনারও কোনো কমতি নেই। তবে তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে ভারতের বারবার প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কারণে ফেনী নদী নিয়ে এই বদান্যতা অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখেননি। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন না হওয়া এবং আসামের নাগরিক তালিকা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস সত্ত্বেও তাঁরই দলের নেতাদের অবিরাম বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে।

এর মধ্যে ফেসবুকে ভারতবিরোধী পোস্ট দেওয়ার কারণেই ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে নৃশংসভাবে নির্যাতন ও হত্যা করেছেন বলে প্রতীয়মান হওয়ায় পানি ঘোলা হয়েছে আরও। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সংবাদ সম্মেলনে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর পরিপ্রেক্ষিত ও যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। প্রাকৃতিক নিয়মেই এ নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে।

তিস্তা, ফেনী, গ্যাস, বন্দর, নাগরিকপঞ্জি—এসব নিয়ে ডামাডোলের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক নিয়ে প্রায় কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের উপকূলে ভারতীয় নজরদারি রাডার স্থাপন–সংক্রান্ত। norendramodi.in ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ৭ নম্বর সমঝোতা স্মারকের শিরোনাম ‘এমওইউ অন প্রভাইডিং কোস্টাল সার্ভিলেন্স সিস্টেম’ (উপকূলীয় নজরদারি সিস্টেম প্রদান–সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক)। এটি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ভারতের হাইকমিশনার নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন। এরূপ একটি চুক্তির কথা আগে শোনা যায়নি। স্বাক্ষরের পরও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই, যখনই কোনো চুক্তির শর্তাবলি জানা যায় না, তখনই এ নিয়ে জল্পনাকল্পনা পাখা মেলে।

সমঝোতা স্মারকের শিরোনামে ‘প্রভাইডিং’ কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ বিক্রয় হতে পারে, আবার বিনা মূল্যে উপহার দেওয়াও হতে পারে। ভারতের দ্য ইকোনমিক টাইমস পত্রিকা ৮ অক্টোবর এ নিয়ে দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর একটি বড়সড় লেখা বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। তাতে এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার বাংলা অনুবাদ করলে দঁাড়ায় এ রকম; ‘...এই সমঝোতা স্মারকের ফলে দিল্লি বাংলাদেশে একটি উপকূলীয় নজরদারি সিস্টেম স্থাপনের সুযোগ পাবে...ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দিল্লির রণকৌশলগত অবস্থান এতে শক্তিশালী হবে এবং এই রূপকল্পে ঢাকা একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে আবির্ভূত হবে।...সাগরপথে সন্ত্রাসী হুমকি এবং বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এটা হবে খুবই উপকারী।’ বিষয় যদি এটাই হয়, তাহলে তো মনে হয়, বিক্রয় বা উপহারের কোনো ব্যাপার নেই।

আমাদের ‘নিরাপত্তা বিশ্লেষক’দের পক্ষ থেকে এ নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে কোনো বিশ্লেষণ আমার নজরে আসেনি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বরাতে ৭ অক্টোবরের মানবজমিন–এ একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের নৌ-সীমানায় নজরদারি বাড়াতে এবং ভারত-বাংলাদেশ অভিন্ন উপকূলে দৃষ্টি রাখতে এসব রাডার স্থাপন করবে ভারত। বিশেষ করে এই অঞ্চলে চীনা যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের উপস্থিতির কারণে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছে ভারতীয় মিডিয়া।’ মানবজমিন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন ও সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম হারুন অর রশিদের মতামত চেয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সুসম্পর্কের আলোকে এ নিয়ে চীন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেবে, তা ভেবে বিস্ময় প্রকাশ করেন। অন্যদিকে এই চুক্তি থেকে বাংলাদেশ কী উপকার পাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে জেনারেল হারুন অর রশিদ বলেন, চুক্তিটির বিস্তারিত প্রকাশ করার পরে তা জানা যাবে।

সমঝোতা স্মারকের শর্তাবলি প্রকাশিত না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটি বিষয়ে কৌতূহলের উদ্রেক হচ্ছে,

১. আপাতদৃষ্টিতে এই রাডারগুলো একরকম সামরিক স্থাপনা। আমাদের পক্ষ থেকে স্মারকে সই করেছেন স্বরাষ্ট্রসচিব, কিন্তু ভারতের পক্ষে তাদের হাইকমিশনার। তাই ভারতের দিক থেকে এ বিষয়ে কোন প্রতিষ্ঠান জড়িত, সাধারণের কাছে তা স্পষ্ট নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্থাপনাগুলোর মালিকানা কার হবে—বাংলাদেশের, না ভারতের।

২. ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সামরিক জোটবদ্ধতা নেই। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের মালিকানায় কোনো সামরিক স্থাপনা থাকা কীভাবে সম্ভব?

৩. মালিকানা যদি বাংলাদেশের হয়, তাহলেও প্রশ্ন থাকে, এতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার এবং প্রাপ্ত তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কার?

৪. বঙ্গোপসাগরে চীনা উপস্থিতি যদি নজরদারির আওতাভুক্ত হয়, এবং সেই তথ্য যদি ভারতীয়রা প্রকৃত সময়ে পেতে থাকে, তবে সেটা কি চীনের প্রতি বৈরী কার্যক্রম হিসেবে দেখা হবে না? আর সে ক্ষেত্রে আমাদের বিদেশনীতিতে যে একধরনের ভারত-চীন ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা আছে, তার কী হবে?

আমার মনে হয়, এ প্রশ্নগুলো নিয়ে কোনো রাখঢাক না করে যদি উত্তরগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে এ নিয়ে বিরূপ জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটবে। দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে নিরাপত্তাসংক্রান্ত সহযোগিতা হতেই পারে। তথ্য আদান–প্রদানও কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তবে বাংলাদেশ থেকে উদ্ভূত তথ্যের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। বন্ধুদেশের নিরাপত্তার প্রয়োজনে আমরা তা তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারি অবশ্যই।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান, এটা সর্বজনবিদিত। দুই দেশ থেকেই বলা হচ্ছে যে এই সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ যখন তার নৌবাহিনীর জন্য চীন থেকে দুটি পুরোনো সাবমেরিন সংগ্রহ করে, তখন এ বিষয়ে ভারতের অস্বস্তি ছিল বেশ প্রকাশ্য। বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ভারতের জন্য কখনোই ন্যূনতম কোনো হুমকি নয়। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান (৪৫তম) মিয়ানমারেরও (৩৭তম) নিচে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতার সামান্য বৃদ্ধিতে অন্য বন্ধুর বরং স্বস্তিবোধ করার কথা। মার্কিনরা যেমন তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের সামরিক ব্যয় আরও বাড়াতে বলছে। এর মধ্যে পত্রিকান্তরে একটা খবর দেখলাম যে ভারত মিয়ানমারকে একটি রাশিয়ার তৈরি কিলো ক্লাস সাবমেরিন প্রদান করছে।

তর্কের খাতিরে ধরা যাক যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটা যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হলো। আমরা নিশ্চয় চাইব না আমাদের নৌবাহিনীর সব জাহাজের গতিবিধির সব খবর তৎক্ষণাৎ মিয়ানমারের কাছে পৌঁছে যাক। বাংলাদেশের উপকূলে স্থাপিত নজরদারি রাডার এবং তার সব তথ্য–উপাত্তের ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাই বাংলাদেশের হাতে থাকা খুবই জরুরি। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা এসব বিষয়ে আরও অর্থবহ আলোকপাত করতে পারেন।

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব