মৃৎশিল্পীদের খোঁজে বরিশালে

মৃৎশিল্পী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী ও অন্য অতিথিরা। ছবি: মোহাম্মদ সাইয়ান
মৃৎশিল্পী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী ও অন্য অতিথিরা। ছবি: মোহাম্মদ সাইয়ান

যাঁরা একবার ঢাকা থেকে লঞ্চে বরিশাল গিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে আরামদায়ক ভ্রমণ। আর সেই আরামদায়ক ভ্রমণ আরও আনন্দময় হয় যখন রফিকুন নবীর নেতৃত্বে একদল চারুশিল্পী, লেখক-সাংবাদিক সহযাত্রী হন। আড্ডা, গল্প, হাসি–ঠাট্টায় কখন যে রাত গভীর হলো টের পাওয়া গেল না। বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে, নিচে অফুরন্ত জলরাশির ওপর জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ছে। লঞ্চ চাঁদপুর ছাড়িয়ে মেঘনা পার হতেই দেখি নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে আলোর মিছিল। প্রতি রাতে ঢাকা থেকে শ খানেক লঞ্চ বরিশাল যায়, আবার বরিশাল থেকেও শ খানেক লঞ্চ ঢাকায় আসে। বিশাল মেঘনাবক্ষে চলন্ত লঞ্চের ফ্লাডলাইট ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। এ সময়ে কে আর নিজেকে কেবিনে বন্দী করে রাখে?

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে/ যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।’ ৪ ও ৫ অক্টোবর বরিশালে মৃৎশিল্পীদের সম্মেলনে গিয়ে সেই মাটির টানই আবার অনুভব করলাম। দুঃসহ যানজট ও ইট-পাথরে বন্দী ঢাকায় বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ঢাকার বাইরে গেলেই বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সকালে অশ্বিনীকুমার টাউন হলে পৌঁছাতেই দেখি এক পাশে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। অন্য পাশে দেয়াল ঘেঁষে মৃৎশিল্পীরা মাটির তৈরি নানা সামগ্রী সাজিয়ে বসে আছেন। বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ছাড়াও টাঙ্গাইল, সাভার, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজবাড়ী, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ থেকেও শিল্পীরা এসেছেন।

কয়েকজন মৃৎশিল্পীকে দেখলাম টাউন হলে বসেই মাটি দিয়ে শৌখিন সামগ্রী তৈরি করছেন। কথা হলো নওগাঁ অঞ্চলের এক শিল্পী দম্পতির সঙ্গে। তাঁদের দুজনের কাজ ভিন্ন। নারী শিল্পী শৌখিনসামগ্রী  বানান আর পুরুষ শিল্পী ব্যবহারিক পণ্য।  পটুয়াখালীর বাউফল থেকে আসা মধ্যবয়সী এক শিল্পী নিয়ে এসেছেন বাহারি সব মাটির পাত্র—বাসন, চায়ের কাপ, মগ, ফুলদানি। জিজ্ঞেস করি, কেমন বিক্রি হচ্ছে? পোশাক ও চেহারার মালিন্য কাটিয়ে তিনি বললেন, ভালো। এই মানুষগুলোর বাড়তি কোনো চাহিদা নেই। কষ্ট হলেও তাঁরা বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখছেন। তাঁদের কাছে এটি শুধু জীবিকা নয়, শিল্পচর্চাও বটে।

ঠিক সকাল সাড়ে ১০টায় মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন শিল্পী রফিকুন নবী। ঢাকা থেকে আরও গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রফিকউল্লাহ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন, চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামান মনির, ময়নুল আবেদিন, কোহিনুর আবেদিন, স্থপতি আমিনুল ইসলাম, শিল্প সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ, গবেষক নাসির শারমিন, এটিএন বাংলার বার্তা প্রধান জ ই মামুন এবং এই নিবন্ধের লেখক। স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও শিল্পীরা তো ছিলেনই। আগের দিন মৃৎশিল্পীদের তৈরি পণ্য প্রদর্শনীর সঙ্গে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অনেক শিশু আঁকিয়ে অংশ নিয়েছিল।

বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় মৃৎশিল্পী আছেন, যাঁরা কুমার বা পাল নামে পরিচিত। কিন্তু তাঁদের তৈরি সামগ্রীর কদর কমে গেছে। পসার ঘটেছে প্লাস্টিক, কাচ, এনামেল–সামগ্রীর। এনামেল–সামগ্রী অপেক্ষাকৃত টেকসই। কিন্তু কাচের সামগ্রী মাটির পণ্যের মতোই ভঙ্গুর। আর প্লাস্টিক সামগ্রী পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতএব, এখনই আমাদের সজাগ হওয়া উচিত। আমরা যদি প্লাস্টিক সামগ্রীর বদলে মৃৎসামগ্রী ব্যবহার করি তাহলে সেটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ভালো, তেমনি এই শিল্পীরাও খেয়ে–পরে বাঁচতে পারেন।

অনেকের অভিযোগ, মৃৎশিল্পীদের তৈরি সামগ্রীর মান উন্নত নয়, কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে তাঁরা এসব পণ্য তৈরি করে আসছেন বাপ-দাদাদের কাজ দেখে দেখে। সামান্য প্রশিক্ষণ পেলে তাঁরাও অনেক উন্নত মানের সামগ্রী তৈরি করতে পারেন। গেল শতকের ষাটের দশকে কুমিল্লা বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান মৃৎশিল্পীদের নিয়ে প্রথম সমবায় সমিতি গঠন করেছিলেন। তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানকার শিল্পীদের তৈরি মৃৎসামগ্রীর কদর দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। ১৯৮১ সালে বাউফলের শিল্পীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন পটুয়াখালীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুস শাকুর। পরে সেখানকার শিল্পীরা আড়ং ও কারিতাসের নকশা অনুযায়ী মৃৎসামগ্রী তৈরি করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁদের তৈরি শৌখিন সামগ্রী যেমন শহরের ভদ্রলোকদের ড্রয়িংরুমে শোভা পাচ্ছে, তেমনি রপ্তানিও হচ্ছে। শুধু শৌখিন পণ্য নয়, ডিনার সেটসহ মাটির তৈজসপত্র ১৮টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর বাইরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাও (বিসিক) কিছু কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এটি আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন।

মৃৎশিল্পী সম্মেলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক সুশান্ত ঘোষ বললেন,  দক্ষিণাঞ্চলে মৃৎশিল্পীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাঁদের তৈরি পণ্যসামগ্রীর বাজার পড়ে যাওয়ায় অনেকে বাপ-ঠাকুরদার পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। শিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিতে পারলে দেশ-বিদেশে মৃৎসামগ্রীর চাহিদা বাড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব। সুশান্ত ঘোষ ও তাঁর সহযোগীরা ১১ বছর ধরে মৃৎশিল্পীদের নিয়ে কাজ করছেন। প্রথমে সম্মেলনে শুধু বরিশাল অঞ্চলের মৃৎশিল্পীরা অংশ নিতেন। এখন সারা দেশ থেকেই শিল্পীরা আসছেন। এ বছর সম্মেলনে ১৪ জন শিল্পীকে সম্মাননা দেওয়া হয়। শিল্পী বলহরি সাহা স্মৃতি আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মৃৎশিল্পী ধীরেন্দ্রনাথ পাল এবং চিত্রশিল্পী চিত্ত হালদার আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন বরিশালের বাখরগঞ্জের মহেশপুরের মৃৎশিল্পী উষা রানী পাল। দূরদূরান্ত থেকে আসা এসব শিল্পীর মূঢ় ম্লান মুখ দেখে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। যে শিল্পীরা আবহমান বাংলার ঐতিহ্য লালন করছেন, আমরা তাঁদের জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না!

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মৃৎশিল্পকে বাংলাদেশের শাশ্বত শিল্প-ঐতিহ্যের অলংকার হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। গ্রামবাংলার গণমানুষের হাতে তৈরি এসব শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি সোনারগাঁয়ে গড়ে তুলেছিলেন লোকশিল্প জাদুঘর। কিন্তু মৃৎশিল্পকে শুধু জাদুঘরে বন্দী রাখলে হবে না। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখতে হলে একে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। এই শিল্পীদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার রকমের মৃৎপণ্য বা মাটির জিনিস তৈরি করা হয়। এগুলোর মধ্যে আছে হাঁড়ি-পাতিল, বাটি, বদনা, মটকা, প্রদীপ, ছাইদানি, গেলাস, সানকি, ঘড়া, কল্কি, গামলা, জটধুসি, জলকান্দা, চুনপাত্র, সরাই, দুধের হাঁড়ি, ফুলদানি, মালসা, থালা, পানের বাটা, খেলনা, কলসি, মুবঘট, লক্ষ্মীঘট, আয়োঘট, পূজার ঘট, দোয়াত–বয়াম, লক্ষ্মীর সরা, মটকা, কাজলবাটি নাদা, তবলার বায়া, মৃদঙ্গ নাল, পাখোয়াজের মাটির খোল ইত্যাদি। এর সবটাই আমাদের কাজে লাগবে না ঠিক, কিন্তু অনেকগুলো আমরা ঘরে বা অফিসে ব্যবহার করতে পারি।

বরিশালে মৃৎশিল্পীদের সম্মেলনে গিয়ে মনে হলো এ ধরনের সম্মেলন সবখানে হওয়া প্রয়োজন। তাতে শিল্পের যেমন প্রসার ঘটবে, তেমনি শিল্পীদের মধ্যে উন্নত সামগ্রী বানানোর প্রতিযোগিতা থাকবে। সর্বোপরি মৃৎশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্রেতাদের বোঝাতে হবে যে একটি মৃৎসামগ্রী কেনা মানে একজন শিল্পীকে উৎসাহিত ও সহায়তা করা। এর পাশাপাশি বাঁশ, বেত ও পাটের তৈরি সামগ্রীরও ব্যবহার বাড়াতে হবে।

সম্মেলনের প্রথম দিনে বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নিজে চাকতি ঘুরিয়ে কাদামাটির কলসি বানিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে হয়তো তিনি মৃৎশিল্পীদের উৎসাহিত করতে চেয়েছেন, কিন্তু তাঁরা প্রকৃত উৎসাহ পাবেন যদি সিটি করপোরেশন অফিসে ও সিটি করপোরেশন এলাকায় মৃৎসামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানো হয়। ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব ট্রেনে চা খাওয়ার জন্যমাটির ভাঁড় ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছিলেন। আমাদের অনেকেই কলকাতায় গিয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খান। কিন্তু দেশের ভেতরে কেন সেটি সম্ভব হবে না?

আলাপ প্রসঙ্গে সুশান্ত ঘোষ জানান, তাঁরা বাংলাদেশেও মাটির ভাঁড় ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছেন। কাজটি দেখার জন্য ভারতে একটি প্রতিনিধিদলও পাঠিয়েছেন। সেখানে প্রতিটি মাটির ভাঁড় তৈরির খরচ পড়ে ৮০ পয়সা। চেষ্টা থাকবে আরও কম খরচে মাটির ভাঁড় দেওয়া। অন্যথায় দোকানদারেরা নিতে রাজি হবেন না। প্লাস্টিকের তৈরি কাপও একবার ব্যবহৃত হয়, মাটির ভাঁড়ও। আমরা যদি প্লাস্টিক কাপের বদলে মাটির কাপ ব্যবহার করি, তাতে পরিবেশদূষণ যেমন কমবে, তেমনি মৃৎশিল্পীদের আয়রোজগারও বাড়বে।

পরিবেশদূষণে উদ্বিগ্ন সরকার বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]