মোদির হাত ধরে পতনের ধারায় অর্থনীতি

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি

মাত্র কয়েক বছর আগেও ভারতের প্রবৃদ্ধির গতি সন্দেহাতীতভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। টানা এক দশক বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশের বেশি ছিল। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনকই ছিল। ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত এই হার ৭ শতাংশ ছিল। তখন পর্যন্ত মনে হচ্ছিল এই অর্জনের গতিধারাকে কোনো কিছুই রুখতে পারবে না।

এরপর মোদি সরকার এসেই বিনা নোটিশে ৮৬ শতাংশ কাগুজে নোট বাতিল করে বিরাট অর্থনৈতিক ভুল করে বসল। সেই ধাক্কা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ওই সিদ্ধান্তের কারণে কোটি কোটি লোক চাকরি হারিয়েছে; লাখ লাখ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এরপরও মোদি সরকার অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা লুকিয়ে রেখে জনগণকে ভুল তথ্য–উপাত্ত দেখিয়ে যাচ্ছে। নোট বাতিলকে যদি খারাপ আইডিয়ার খারাপ বাস্তবায়ন হিসেবে ধরি, তাহলে আমাদের সামনে ভালো আইডিয়ার খারাপ বাস্তবায়নের উদাহরণও আছে। সেটি হলো: দেশজুড়ে জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) বা পণ্য পরিষেবা কর চালু করা।

দুনিয়ার সব দেশেই একটি সরল, সাধারণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক জিএসটি অনুসরণ করা হয় এবং তা ভালোভাবেই কাজ করে থাকে। কিন্তু মোদি সরকার চালু করেছে সরল নয়, বহুস্তরের জিএসটি। পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন হারের কর পদ্ধতি থাকার পরও সরকার তাড়াহুড়ো করে একটি জোড়াতালি দেওয়া কর পদ্ধতি চালু করেছে। নোট বাতিল ও বহুস্তর জিএসটি—মোদির এই দুটি উদ্যোগে অর্থনীতি বিপথে পরিচালিত হচ্ছে এবং এ বছর প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে চলে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সব জায়গা থেকে খারাপ খবর আসছে। বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, ৮. ৪ শতাংশ। এই হার আরও বাড়ছে। কৃষি খাতও মুষড়ে পড়েছে। রেকর্ডসংখ্যক কৃষক দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছেন। কলকারখানার উৎপাদন, রপ্তানি—সব সূচক নিম্নমুখী। কয়লা, অশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট, সার, ইস্পাত, সিমেন্ট ও বিদ্যুৎ—ভারতের এই মূল আটটি খাতে গত আগস্টে ০.৫ শতাংশ অবনমন ঘটেছে।

ব্যাংকগুলোর অলস সম্পদের (নন-পারফর্মিং অ্যাসেটস, সংক্ষেপে এনপিএস) বোঝা বাড়ছে। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দেনার পরিমাণ দেড় হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং একটির পর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তদন্তের আওতায় আসছে। ঋণগ্রহণকারীরা ঋণ শোধ করতে পারছে না। ফলে তাদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা এনপিএসের বোঝা ব্যাংকের ঘাড়ে জমা হচ্ছে। বিনিয়োগের বাতি এখন মিটমিট করে জ্বলছে। ফ্ল্যাট–প্লট বিক্রি সাংঘাতিকভাবে কমে যাওয়ায় এখন বহু আবাসন কোম্পানি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ভোক্তাদের সম্পদের ঘাটতি থাকায় তাদের ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চাইছে না, আবার বিনিয়োগকারীরাও ঋণ নিতে ভয় পাচ্ছে। অর্থনীতির এই দুরবস্থা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। অন্যান্য আর্থিক পিছুটানের পাশাপাশি ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর নীতি-সিদ্ধান্তও এই অবস্থার জন্য দায়ী।

আর্থিক অবনমনের প্রভাব সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনেও প্রতিফলিত হচ্ছে। ভারতীয়রা চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খেয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বিস্কুটের বিক্রি ৮ শতাংশ কমে গেছে। ভারতীয় পুরুষদের অন্তর্বাস বিক্রি ভয়াবহ রকমের পড়ে গেছে, যার মাধ্যমে সাধারণ ভোক্তাদের প্রাত্যহিক জীবনের দুর্দশা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কয়েকটি প্রতিবেদন বলছে, ভারতের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির রাজধানী হিসেবে পরিচিত তামিলনাড়ুর তিরুপুরে অন্তর্বাস বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গেছে। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির দাম রেকর্ড পরিমাণ নিচে নেমে এসেছে, যার ফলে প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করা আগের চেয়ে ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে।

এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্যিক পার্টনার হিসেবে ভারতের প্রতি তিক্ত আচরণ শুরু করেছেন। হিউস্টনে ট্রাম্প এবং মোদির মধুর কোলাকুলির দৃশ্যের আড়ালে যে স্বার্থের টানাপোড়েন আছে, তা দেখা যায়নি। এরপরও সরকার নির্বিকার রয়েছে। সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে বিমর্ষ করে ফেলেছে। অপ্রত্যাশিত কর আরোপ করায় বহু বিদেশি বিনিয়োগকারী ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন।

মোদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন, এবার তিনি দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হতাশা দূর করার মতো সাহসী পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু সে রকম কোনো উদ্যোগই তিনি নেননি। এমনকি স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনার মতো কিছুও না। কৃষি খাতের অচলাবস্থা, শ্রম আইনের কড়াকড়ি, জমির দাম নির্ধারণে সরকারের বিধিনিষেধ আরোপ—এই ধরনের দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা বিষয় এই সরকারের অ্যাজেন্ডায় অনুপস্থিত রয়েছে। সরকারের রাজস্ব কমে যাওয়ায় কর কর্মকর্তাদের ওপর রাজস্ব বাড়ানোর বিষয়ে চাপ বাড়ছে। এই চাপের কারণে তাঁরা যত্রতত্র হানা দিচ্ছেন, যা এখন ‘ট্যাক্স টেররিজম’ নামে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। ট্যাক্স টেররিজমের ভয়ে বহু কোটিপতি ভারত ছেড়ে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। গত বছর পাঁচ হাজার কোটিপতি দেশ ছেড়েছেন। এ বছর এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

উপসংহারে যা না বললেই নয়: ভারতের মহা প্রবৃদ্ধির গল্প আপাতত স্থবির হয়ে আছে এবং বিপথে ধাবমান এই অর্থনীতিকে মোদি সরকার আবার ঠিক রাস্তায় আনতে পারবে—এমন আশা কারোরই করা উচিত হবে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব