ডান হাত বুকে রেখে শপথ

ডান হাতটা বুকের ওপর রেখে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রুখে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েছেন বুয়েটের উপাচার্যসহ শিক্ষার্থীরা। শপথ নেওয়া খুব ভালো। শপথ নেওয়ার পর যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, তা পালন করা আরও ভালো। কেউ সেই শপথ ভঙ্গ করলে প্রত্যেকে মিলে তাকে প্রতিহত করা আরও বেশি প্রয়োজনীয়। আশা করব, বুয়েটসহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও সন্ত্রাস প্রতিরোধের এই শপথ থেকে পিছু হটবে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, সে এক জটিল প্রশ্ন। এ প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর নেই। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা যখন পিকেটিং করেছি, তখন নিজেদের মুক্তিকামী জনগণের অংশ বলেই মনে করেছি। তারও আগে, বায়ান্ন কিংবা স্বাধিকার আন্দোলনের সময়ও শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামার একটা তাৎপর্য ছিল। কিন্তু এখন ছাত্ররাজনীতির নামে কচি বয়সেই আখের গুছিয়ে নেওয়ার যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বের হতে না পারলে এই ছাত্ররাজনীতি কিছু দুর্বৃত্তেরই জন্ম দেবে, আর কিছু নয়। শোনা যায়, উন্নয়নের রাজনীতির জন্য বরাদ্দ টাকার একটা বড় অংশ ঠিকাদারির কল্যাণে এই ছাত্রনেতাদের পকেটে আসে। শোনা যায়, স্থানীয় কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হতে হলেও নাকি মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগঠনের বড় নেতাকে। ভেবে দেখুন, কী সাংঘাতিক ব্যাপার, পড়ালেখা শেষ করার আগেই এক একজন ছাত্রনেতা কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য তঁাদের কোনো পরিশ্রমও করতে হচ্ছে না। তঁাদের না থাকছে আদর্শ, না থাকছে লক্ষ্য, শুধু পেশির জোরেই তাঁরা ক্ষমতা উপভোগ করছেন এবং ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পর অনায়াসলব্ধ জমানো টাকায় জীবন চালিয়ে দিচ্ছেন কিংবা ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে পৌঁছে সে টাকাকে আরও দ্রুত বাড়িয়ে চলেছেন।

এই সংকটকে অবশ্য শুধু ছাত্ররাজনীতির মধ্যে দেখি না। গোটা সমাজ–অর্থনীতি–রাজনীতির একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে এ দেশের প্রত্যেক মানুষের ওপর, তাই ছাত্ররাজনীতির এই অপকীর্তি শিকড়বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। আমরা যদি গভীরে যাই, তাহলে দেখব, সমাজের সর্বক্ষেত্রে বন্ধন আলগা হয়ে গেছে। আদর্শিক বন্ধন নয়, টাকাকড়ির বন্ধন এখন রাজত্ব করছে দেশ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি—সবখানেই জোর যার মুল্লুক তার। গণতন্ত্রের পক্ষে যাঁরা আন্দোলন করতে চান, কিংবা করপোরেট সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করে গণতান্ত্রিকতার চর্চা করতে চান, তঁাদের হালে পানি নেই একেবারেই। রাষ্ট্রই শুধু অগণতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে, তা নয়, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই অগণতান্ত্রিকতার চাষবাস হচ্ছে। পরিবারতন্ত্র শুধু রাজনীতিতে নয়, সব প্রতিষ্ঠানেই আসন গেড়ে বসছে অথবা বসার চেষ্টা করছে। বাজার অর্থনীতির রমরমার মধ্যে এ রকমটাই ঘটার কথা।

ছাত্ররাজনীতি মানে পেশিশক্তি দিয়ে ভিন্নমতের টুঁটি টিপে ধরা নয়। বরং ভিন্নমতের চেয়ে নিজের মতটা কেন শ্রেয়, তা অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করা। ছাত্ররাজনীতি মানে সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মনে রেখে নিজেদের কার্যক্রম ঠিক করা। ছাত্ররাজনীতি মানে ঠিকাদারি নয়, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে পার্সেন্টেজ পাওয়া নয়। বরং নিজের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা কেউ যেন মেরে খেয়ে না ফেলে, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠার অঙ্গীকারই হওয়া উচিত ছাত্ররাজনীতির নিয়ামক শক্তি। সেদিকে এগোনো যায় কি না, সেটাই এ মুহূর্তে ছাত্ররাজনীতির মূল ভাবনা হলে ভালো হয়।

২.

খুবই দুশ্চিন্তার বিষয় আরেকটি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে র‍্যাগিং চলেছে দিনের পর দিন, তা কী করে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল? আমরা কেন জানতাম না, র‍্যাগিংয়ের নামে একজন শিক্ষার্থীকে এ রকম অপমান করা হয়? যাঁরা এর শিকার হন, তাঁরাই–বা কেন তা গোপন করেছেন? প্রভাবশালী ভয়ংকর মানুষদের ভয়ে? তার মানে, সম্মিলিত শক্তি বলে এখন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই?

ছাত্ররাজনীতির চেয়ে র‍্যাগিংকে আরও অনেক বেশি ভয়ংকর বলে মনে হয়। র‍্যাগিংয়ের বৈশিষ্ট্য হলো, এর ঘটক এবং শিকারের জন্য রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য নয়। যিনি জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, তিনিই নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীকে অপমান করার সুযোগ হাতে পাবেন। এ ক্ষেত্রে ছেলে–মেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই। র‍্যাগিংয়ের নামে যে অপমান, তা ভীষণ রকম নির্দয় হলেও এ নিয়ে কেউ কিছু বলে না, বলবে না। এমনকি শিক্ষকেরাও সবকিছু জেনে বুঝে চুপ করে থাকেন।

প্রশ্ন হলো, যাঁরা তাঁদের অনুজদের অপমান করছেন, তাঁরা আসলে কী শিখেছেন বা কী শেখাচ্ছেন? দু–একটি উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। পর্নো ছবি দেখিয়ে সে রকম অভিনয় করতে বলা হয়, হস্তমৈথুন করতে বলা হয়, মেয়েদের অপমান করার জন্য কোনো ছেলের সঙ্গে তাঁকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ইচ্ছেমতো পেটানো জায়েজ। উদাহরণ বাড়াব না। এই কয়েকটি উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী সাংস্কৃতিকভাবে অধঃপতিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছেন। নতুন শিক্ষার্থীও তক্কে তক্কে থাকেন, কবে তিনি জ্যেষ্ঠ হবেন এবং কবে তিনি নতুন শিক্ষার্থীদের একই রকমভাবে অপমান করে নিজের অপমানের প্রতিশোধ নেবেন।

তাহলে হলোটা কী? হলো এই যে, গোটা উচ্চশিক্ষাঙ্গনটার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিল। যাঁরা র‍্যাগিংয়ের মতো অপমানের সামনে ফেলতে পারেন কোনো মানুষকে, তাঁরা কি সুস্থ মানসিকতার মানুষ? এক একজন ডিগ্রি নিয়ে কাজে যোগ দেন কিন্তু তাঁদের অসুস্থ মানসিকতা তো ভেতরে ভেতরে থেকেই যায়। তাঁরা কীভাবে মানুষকে ভালোবাসবেন? তাঁদের মনই তো প্রতিহিংসা আর শাস্তিপ্রিয়তায় বন্দী। গোটা উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রের এই কদর্য অমানবিকতার দিকে এখনই দৃষ্টি দিতে হবে। এ বছর যাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, র‍্যাগিং থেকে তাঁদের রক্ষা করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রসংগঠন এবং অগ্রজদেরই। সেই অগ্রজদের, যাঁরা বিভিন্ন সময় র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন কিংবা র‍্যাগিংয়ের ফায়দা লুটেছেন। এ ক্ষেত্রে যদি ছাত্রসংগঠনের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে ছাত্রসংগঠনগুলো এগিয়ে আসুক। অন্তত তারা যা করে বেড়াচ্ছে, তার চেয়ে এটা ঢের ভালো কাজ হবে।

তখনই শুধু ডান হাত বুকে দিয়ে শপথ করার বিষয়টি শুধু লোকদেখানো শপথের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পরিবর্তনগুলো না এলে তা লোকদেখানো শপথ পর্যন্তই আটকে থাকবে। ফেসবুকে যেমন একটি ঘটনা টিকে থাকে আরেকটি প্রবল ঘটনা আসা পর্যন্ত, এই শপথও তেমনি হারিয়ে যাবে নতুন কোনো আলোড়নের পর।

জাহীদ রেজা নূর: সাংবাদিক