গ্যাস সিলিন্ডার যখন বোমা

১৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের আনোয়ারায় রোগী বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্সের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে একই পরিবারের তিনজন মানুষের মৃত্যু এবং তিনজনের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনাটি আমরা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে চাই। কারণ, সিএনজিচালিত যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে, কিন্তু এর প্রতিকারের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। বছরে কত মানুষ এভাবে মারা যায়, কত মানুষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারায়—এ বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে কিছু অনুমাননির্ভর হিসাব করা হয়, যা থেকে প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। পরিসংখ্যানের অভাব থেকেও বোঝা যায়, সমস্যাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না।

গ্যাস সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট আয়ু থাকে। সরকারের বিস্ফোরক অধিদপ্তরের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডারের আয়ু ১০ থেকে ১৫ বছর হয়ে থাকে। এই সময় পরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। তাই আয়ু শেষ হলে সেগুলো বাতিল করা উচিত—এটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই কাণ্ডজ্ঞানের ঘাটতি অত্যন্ত প্রকট। কত বছর ধরে একটি সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে, ব্যবহারকারীদের কাছে সেই হিসাবও থাকে না। বছর তিনেক আগে বিস্ফোরক অধিদপ্তর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ১১ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করেছিল। তারা দেখতে পেয়েছিল, আট হাজার সিলিন্ডারই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, তাই সেগুলো তখন বাতিল করা হয়। এ থেকে অনুমান করা যায়, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকির মাত্রা কত ব্যাপক।

মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী বোমার সঙ্গে তুলনীয়। আনোয়ারায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অ্যাম্বুলেন্সটি যেভাবে দুমড়েমুচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, তার ছবি দেখে মনে হয় যে সেটি শক্তিশালী বোমা হামলার শিকার হয়েছিল। বেসরকারি যেসব কোম্পানি গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করে, তারা কী মানের সিলিন্ডার সরবরাহ করে, সেগুলোর নিরাপত্তার অবস্থা কী, কত দিন ব্যবহারযোগ্য ইত্যাদি বিষয়ে নজরদারির প্রকট অভাব রয়েছে।

সরকারের রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাইভেট কারসহ সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি। প্রতিষ্ঠানটি সিএনজি কনভারশন সেন্টারগুলোর অনুমোদনও দেয়। তারা এ পর্যন্ত ১৮০টির বেশি কনভারশন সেন্টারের অনুমোদন দিয়েছে, তবে কাজ করে মাত্র ১০ থেকে ১২টি। যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তর করার পর প্রতি পাঁচ বছরে একবার সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা (রিটেস্ট) করার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। তা করা হয় কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব বিস্ফোরক অধিদপ্তরের। গত বছর পর্যন্ত সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করার ওয়ার্কশপের সংখ্যা ছিল মাত্র আটটি। অথচ বাংলাদেশে যানবাহনে সিএনজির ব্যবহার শুরু হয়েছে দেড় দশকের বেশি সময় আগে। অর্থাৎ প্রথম সিএনজিতে রূপান্তরিত যানবাহনগুলোর সিলিন্ডারের আয়ু শেষ হয়েছে, কিন্তু সেগুলো পুনঃপরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাই ছিল না। অর্থাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক সিএনজিচালিত যানবাহন চলাচল করছে। শুধু যানবাহনে নয়, বাসাবাড়িতেও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও মাঝেমধ্যেই ঘটে। বেলুন ফোলানোর কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণেও মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এই সিলিন্ডারগুলোর ঝুঁকি খুব বেশি, কারণ এগুলোর একটা বড় অংশ পুরোনো সিলিন্ডার কেটে বানানো হয় বলে জানা যায়।

গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা নানাভাবে ঘটে। সিলিন্ডার ভালো থাকলেও নিম্নমানের রেগুলেটর ব্যবহার করা হলে আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। গ্যাসের চুলা ব্যবহারে যথাযথ সতর্কতা ও সচেতনতার অভাবেও দুর্ঘটনা ঘটে। এসব সমস্যা দূর করার জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে উদ্যোগী হতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডারের গুণগত মান নিশ্চিত করা, সেগুলোর নিয়মিত পুনঃপরীক্ষার ওপর নিয়মিত নজরদারি করার পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া প্রয়োজন।