শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্রের অবসান ঘটছে?

শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে? ছবি: রয়টার্স
শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে? ছবি: রয়টার্স

এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন গণতন্ত্র হয়তো বিপন্ন হতে যাচ্ছে। আগামী মাসে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের পরিবারের আরও একজন সদস্য ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যিনি কর্তৃত্ববাদ, সহিংসতা ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ততার জন্য বেশ সুপরিচিত। এক বছর আগে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার একটি সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের কারণে শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্র প্রায় বিপন্ন হতে যাচ্ছিল। যাহোক সেই সময় গণতন্ত্র রক্ষা পেলেও ভবিষ্যতে তা হয়তো আর সম্ভব হবে না।

গোটাবায়া রাজাপক্ষে আগামী মাসে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী। এর আগে তিনি সিরিসেনার পূর্বসূরি তাঁর বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষের অধীনে শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষাপ্রধান হিসেবে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক দশকের (২০০৫–১৫) মেয়াদে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ব্যাপক স্বজনপ্রীতি করেছিলেন। সরকারের অনেক মন্ত্রণালয় মাহিন্দার চার ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সরকারি ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। মাহিন্দা অবিচ্ছিন্নভাবে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রসারিত করে দৃশ্যত স্বৈরশাসন প্রবর্তন করেছিলেন।

এ ছাড়া মাহিন্দার চীনপন্থী বৈদেশিক নীতি শ্রীলঙ্কায় চীনা প্রভাবের দ্রুত প্রসার ঘটায় এবং চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই ঋণের কারণেই ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সরকার ১১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে কৌশলগত বন্দর হাম্বানটোটার নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের জন্য চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হয়। চুক্তি অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন একটি চীনা কোম্পানি ৯৯ বছরের জন্য হাম্বানটোটা বন্দর এবং সংলগ্ন ১৫ হাজার একর জমি শিল্পাঞ্চল তৈরির জন্য ইজারা নেবে। এটা অনেকটা ঊনবিংশ শতাব্দীতে চীনে ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়ে তোলার মতো।

গোটাবায়া তাঁর ভাইয়ের মতো একই কাজ করবেন না, এমনটা ভাবার খুব কম কারণ আছে। কেবল প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষাপ্রধান থাকাকালে যুদ্ধাপরাধের জন্য মার্কিন ফেডারেল আদালতে বিচারাধীন দুটি মামলা থেকে রেহাই পেতে পারেন। মেয়াদকালীন বাধ্যবাধকতার জন্য মাহিন্দা রাজাপক্ষে ফের নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারার কারণে গোটাবায়া রাজাপক্ষে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। আর এ জন্য তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছেন।

২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির তদারকি করেছিলেন মাহিন্দা। কিন্তু তিনি শান্তির কোনো এজেন্ট ছিলেন না। যুদ্ধের চূড়ান্ত বছরগুলোতে, হাজার হাজার মানুষ-সহায়তা কর্মী এবং তামিল নাগরিক থেকে শুরু করে রাজপক্ষের পরিবারের রাজনৈতিক বিরোধীরা নিখোঁজ বা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এবং তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সামরিক আক্রমণ চালিয়েছিল, যা জাতিসংঘের মতে, পুরো শাসনব্যবস্থার ওপর একটি গুরুতর আক্রমণ, যাতে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিল। যুদ্ধকালীন সামরিক কমান্ডার শরৎ ফনসেকার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গোটাবায়া তখন আত্মসমর্পণকারী বিদ্রোহী নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

শ্রীলঙ্কার হিন্দু তামিল সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন করার পরও রাজাপক্ষের ভাইয়েরা দেশের বেশির ভাগ বৌদ্ধ সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এটা মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে একটি বহু জাতির দেশে একক-জাতিগত পরিচয় তৈরির প্রচেষ্টাকে জোরদার করতে উৎসাহিত করেছিল।

গোটাবায়া রাজাপক্ষে নিশ্চিতভাবেই তাঁর ভাইকে অনুসরণ করবেন। আর এ রকম হলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন কখনোই দূর হবে না। শ্রীলঙ্কার সিংহলি ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। এই উত্তেজনার কারণেই গত এপ্রিল মাসে শ্রীলঙ্কার ইসলামপন্থী জঙ্গিরা ইস্টার সানডের দিনে রাজধানী কলম্বোয় একটি সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল, যাতে ২৫৩ জন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়।

রাজাপক্ষেরা ইতিমধ্যে সিংহলি জাতীয়তাবাদীদের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বালানোর জন্য ইসলামি জঙ্গিদের বোমা হামলার ঘটনাটিকে ব্যবহার করেছেন। এবং গোটাবায়া তাঁর সমর্থকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে নির্বাচিত হলে তিনি গোয়েন্দা পরিষেবা শক্তিশালী করবেন এবং নাগরিকদের ওপর নজরদারির কাজটি পুনরায় চালু করবেন, যাতে ইসলামি চরমপন্থাকে চূর্ণ করতে পারেন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে, এমন একজনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনায় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, গণমাধ্যম এবং নাগরিক-স্বাধীনতার সমর্থকদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।

আরও উদ্বেগজনক খবর রয়েছে। গোটাবায়ার শিবির নিশ্চিত করেছে যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি চীনের সঙ্গে ‘সম্পর্ক পুনরুদ্ধার’ করার পরিকল্পনা করছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রতি ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সংশয়ের এই সময়ে শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষের পরিবারের সদস্যের সম্ভাব্য ক্ষমতায় ফিরে আসা চীনের জন্য সুখবর বটে, যারা কিনা শ্রীলঙ্কাকে সামরিক ফাঁড়িতে পরিণত করার ব্যাপারে আশাবাদী। তবে অন্যদের জন্য এটা বাস্তবিকই একটি দুঃসংবাদ।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক