খেতেই ঢলে পড়ছেন কৃষকেরা

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

কীটনাশক ছিটাতে (স্প্রে) গিয়ে খেতেই ঢলে পড়ছেন কৃষক। কেউ দম হারাচ্ছেন সঙ্গে সঙ্গে, কারও প্রাণ যাচ্ছে হাসপাতালে নেওয়ার পথে, কেউবা মারা যাচ্ছেন হাসপাতালে। যাঁরা লোটা কম্বল বেচে বা চড়া সুদে ঋণ নিয়ে হাসপাতাল-ক্লিনিকের চাহিদা মিটিয়ে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন, তাঁদের খবর ছাপা হয় না। একে গরিব, তার ওপর সুস্থ হয়ে গেছেন, এসবের কোনো সংবাদমূল্য নেই। তা ছাড়া কৃষকেরা মেধাবী কেউ নন, তিনি এক ‘আহাম্মক’ বোকা (কীটনাশক কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘বোকার ফসল পোকায় খায়’।) তাঁদের কেউ নৃশংসভাবে হত্যা করার চেষ্টা করেনি, তাঁরা নিজের ইচ্ছায় বিষ কিনে নিজের খেয়ালে বিষ ছিটাতে গিয়েছেন। বিষ কোম্পানিগুলো শুধু বিষটা তাঁদের নাগালের মধ্যেই রেখেছিল। 

 চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার মনপুরা গ্রামের আবু সুফিয়ানের ছেলে তারেক হোসেন ৩ মার্চ রোববার বিকেলে গ্রামের উত্তর বিলে ইরি ধানের জমিতে কীটনাশক স্প্রে করছিলেন। এ সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুই দিন দুই রাত সবাই খুব চেষ্টা করেছিলেন, কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেখান থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল তারেক হোসেনকে। তারপরও ২০ বছরের একটা তরতাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায় গত মার্চে (দেখুন ইত্তেফাক, ৪ মার্চ ২০১৯)। কেউ ভাবতে পারেনি পোকা মারার বিষ ছিটাতে গিয়ে এভাবে কেউ মারা যেতে পারেন। খবর পেয়ে দুদিন পরে পুলিশ গিয়েছিল মনপুরা গ্রামে। ওই পর্যন্তই, কেন হলো, কীভাবে হলো সেসব নিয়ে কোনো তদন্ত করার তাগিদ কেউ অনুভব করেনি। 

বছর দুই আগে পাশের দেশ ভারতের মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে জুলাই থেকে অক্টোবর—চার মাসে ৫০ জনের মতো চাষি এবং কৃষিশ্রমিক ফসলে কীটনাশক প্রয়োগ করতে গিয়ে নিজেরাই বিষে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের চোখে ঝাপসা দেখা, বমি বমি ভাব, চামড়ায় ফোসকা পড়া, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় ৩৬ জনের। অন্যদের চিকিৎসা চলে লম্বা সময় ধরে। কৃষকদের দাবির মুখে মহারাষ্ট্র সরকার প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ রুপি সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিটির প্রধান কিশোর তিওয়ারি নানা প্রমাণ আর অনুসন্ধানের পর বলেন, এই কৃষক মৃত্যু আসলে গণহত্যা। তিনি এর জন্য রাষ্ট্র এবং একটি বিশেষ বহুজাতিক কোম্পানিকে দায়ী করেন। তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, যে কীটনাশক ছড়াতে গিয়ে সেই চাষিদের মৃত্যু হয়েছে, তা অত্যন্ত বিষাক্ত। এগুলো নিষিদ্ধ কীটনাশক। এগুলো ব্যবহার করতে গেলে অত্যন্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়। তদন্ত কমিশন প্রশ্ন তোলে নিষিদ্ধ কীটনাশকগুলোর উৎপাদন কী করে হলো? এগুলো তৈরির সময় কেন জাতিসংঘের গাইডলাইন মানা হয়নি? মহারাষ্ট্রের বাতিল সেসব কীটনাশক তারা আশপাশের দেশে চালান করে দেয়নি তো? তদন্ত ছাড়া এসব সন্দেহের উত্তর মিলবে না। তবে ঘাপলা যে একটা চলছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। না হলে একের পর এক কৃষক মরছে কেন। 

ষাটের দশকে কথিত সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে আসা কীটনাশক স্প্রে মেশিন এ দেশে কৃষকের কাছে নতুন কিছু নয়। দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার উত্তর কাটলা (মাটাল) গ্রামের জার্মান মুরমু যেমন আস্থার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘হামার গাঁওত (গ্রামে) সবাই তো জমিতে এ্যাংকা (এমন) করেই বিষ ছিটায়।’ সারা জীবন তো এ্যাংকা করেই (এভাবেই) হারা জমিত বিষ ছিটে আওছি (আসছি)! হামার কিচ্চু হবে না।’ কিন্তু হচ্ছে এখন। তারেক হোসেনের পর মারা যান জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা গ্রামের কৃষক খলিলুর রহমান। ৫ আগস্ট সকালে নিজের ধানখেতে কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি তিনি। বাড়ি ফিরে আসতে দেরি হওয়ায় পরিবারের লোকজন খুঁজতে গেলে তাঁকে খেতে পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় স্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁকে উদ্ধার করে দ্রুত কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসক খলিলুর রহমানকে মৃত ঘোষণা করেন। 

 বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের ভাটরা গ্রামের আবদুল মজিদ মারা যান গত ৯ সেপ্টেম্বর। ওই দিন বিকেলে নিজের জমিতে কীটনাশক ছিটানোর সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে তাঁকে শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে তাঁকে বগুড়ার শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। 

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার পদ্মবিলা মোল্পালাড়া গ্রামের আবদুস সালাম মারা যান সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯) রাতে। কৃষক সালাম ওই দিন খেতে কীটনাশক দিতে দিতে অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। তাঁকে বিকেলে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। 

চাঁদপুর, জয়পুরহাট, বগুড়া, পাবনার পর মৃত্যুর খবর আসে টাঙ্গাইল থেকে। ৯ অক্টোবর জেলার ঘাটাইল উপজেলার জামুরিয়া গ্রামে আমন ধানখেতে স্প্রে মেশিন দিয়ে কীটনাশক ছিটানোর কাজ প্রায় শেষ হলে কিশোর পুত্রের সামনে খেতে লুটিয়ে পড়েন কৃষক নূরুল ইসলাম। তাঁর ছেলে আর আশপাশের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে ঘাটাইল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। হাসপাতালে নিলেও যে তিনি বাঁচতেন, তা হলফ করে বলা যাবে না। এ রকম রোগী চিকিৎসকদের কাছেও নতুন, তাঁরা বিষপানের রোগীদের চিকিৎসা দিতে জানেন, কিন্তু বিষ ছিটাতে ছিটাতে বিষে আক্রান্ত হতে দেখেননি আগে। 

এসব মৃত্যুর একটিরও তদন্ত হয়নি। খোঁজ নেওয়া হয়নি কার দোষে মরছে এসব গরিব মানুষ। বিরামপুরের জার্মান মুরমু যতই সাহস দেখান না কেন, কৃষকের মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে। প্রাণ হারানোর ভয়ের চেয়ে ভয়ানক এক ভয়, একা হয়ে যাওয়ার ভয়। কাউকে পাশে না পাওয়ার ভয়। এ দেশে কৃষকেরা সংগঠিত নয় বলে, তাঁদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই বলে বিষ বিক্রেতারা দিনদুপুরে কৃষককে তাঁর জমিতেই খুন করে পার পেয়ে যাবে? 

গওহার নঈম ওয়ারা :লেখক ও গবেষক