বুয়েটকে বুয়েটের আইনেই চলতে দিন

বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কিছু স্থায়ী সংস্কার হবে বলে ক্ষীণ আশা ছিল, কিন্তু সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে। এই লেখায় আমরা কয়েকটি বিষয়ে ছাত্রদের ১০ দফা এবং তার সঙ্গে শিক্ষক সমিতিসহ উপাচার্যের মেনে নেওয়ার মধ্যে কিছু অসংগতির দিকে নজর দেব। আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (ইইই) ছাত্র ছিলেন এবং সংগত কারণে এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বের পুরোভাগে রয়েছেন। ছাত্রদের পক্ষ থেকে উপাচার্য ড. সাইফুল ইসলামের পদত্যাগের দাবি তোলা হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন বুয়েটের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে উপাচার্যের পদত্যাগ যুক্তিসংগত মনে করল, সেখানে ছাত্রনেতৃত্বের পক্ষ থেকে তা দরকারি মনে হলো না কেন?

সনি হত্যার পর তৎকালীন ভিসিকে অপসারণ করা হয়েছিল। সনি হত্যাকাণ্ড বলেই নয়, আবরারের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তার সঙ্গে অন্য অনেক সন্ত্রাসের তুলনা চলে না। অবশ্য প্রতিটি ঘটনাই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বিচার্য। তুলনা করা নিরর্থক। তবে আবরার বাক্‌স্বাধীনতার জন্য বলি হয়েছেন, সেটা বিচ্ছিন্ন নয়। সেখানে হন্তারকেরা পদ্ধতিগতভাবে নির্যাতন চালিয়ে গেছে। শুধু নিহত হওয়ার কারণে আমাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে। আমরা গর্জে উঠেছি। ভিসি এটা জানতেন, অথচ ব্যবস্থা নিতেন না। যদি তিনি বলেন, তিনি টর্চার সেলের খবর রাখতেন না, তাহলে তাঁকে অপসারণ করা বেশি প্রাসঙ্গিকতা পেয়ে যায়।

ছাত্রদের ১০ দফার বেশির ভাগই আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডভিত্তিক, কিন্তু বুয়েটের কিছু বিষয়ে অনতিবিলম্বে সংস্কার দরকার। দরকার কতগুলো আইনের কার্যকর প্রয়োগ। এ জন্য দরকার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ, কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্ররা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগতভাবে দাবি তোলেননি। এটা তাৎক্ষণিক। সবাই, বিশেষ করে প্রশাসন ও সরকার অপেক্ষা করছে ওরা কখন ঘরে ফিরবে। ওরা ঘরে ফিরলেই অস্বস্তি মুছে যাবে। শিক্ষক সমিতির শক্তিশালী সংগঠন আছে। তারা দলাদলি ছাড়া সুন্দরভাবে ভোট করে। তারা ঐক্যবদ্ধ।

 কিন্তু এই গুণাবলিসমৃদ্ধ হলেই এ সমাজব্যবস্থার অংশ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী বুয়েটে পরিবর্তন আনা যায় না; তারও প্রমাণ বুয়েটের এই শিক্ষক সমিতি। তারা ভিসির অনিয়মের বিরুদ্ধে কড়া কড়া রেজল্যুশন নিয়ে রেখেছিল, তাতে ভিসির কিছুই হয়নি। সুতরাং বুয়েট পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হয়ে যাবে, যদি ছাত্ররা প্রস্থান করেন। ‘বুয়েট কেমন চলছে’—এই মর্মে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত করার রেজল্যুশন ছিল, কিন্তু সমিতি তা করেনি বা করতে পারেনি। ছাত্ররাও অমন দাবি তুলবেন না, অভিভাবকেরাও তুলবেন না।

এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, তার প্রতি কোনো পদ্ধতিগত সাড়া আমরা দেখিনি। কারণ, আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট, এমনকি শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বোর্ড অব রেসিডেন্স কোনো বৈঠকে বসেনি। উপাচার্যের দিক থেকে সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি ঘটেছে, তিনি যে প্রক্রিয়ায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে।

আমরা জনপ্রিয় সিদ্ধান্তের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ি। সে কারণেই দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের খবরটিকে বড় শিরোনাম বানাতে পেরে আমরা স্বস্তি পেয়েছি। ভেবেছি, সমাজের প্রতি আমরা দায়িত্বটা সারলাম। অথচ উচিত ছিল সনি হত্যার পর একইভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে যে রাজনীতিটা হয়েছিল তার অসারতা তুলে ধরা। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলাম, তা-ও ‘নিজস্ব ক্ষমতাবলে’, ভিসি একটা সস্তা রাজনীতি করলেন। আমরা বোকার মতো সেটাকে বাহবা দিলাম। ভিসি তাঁর সিদ্ধান্তের বৈধতা বুয়েট আইন থেকে নেননি, নিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের হেডলাইন থেকে।

অথচ এখন ভিসির জবাবদিহির সময়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নয়। তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। তাঁর চাকরির শর্ত হলো তিনি ক্যাম্পাসে থাকবেন। তিনি অসদাচরণ করে চলেছেন। কারণ, তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে থাকেন।

জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে ভিসি বলেছেন, ‘নিজস্ব ক্ষমতাবলে আমি ক্যাম্পাসে সব ধরনের সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি।’ এই ক্ষমতা নির্দিষ্টভাবে আছে, এমন বিধান নেই। তিনি জরুরি ভিত্তিতে যে একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট বা বোর্ড অব রেসিডেন্সের সভা ডাকলেন না, সেটা অমার্জনীয় অসদাচরণ। সেটা তিনি করেননি বলে আমরা তাঁর সিদ্ধান্তের শুদ্ধতা এবং ঔচিত্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি। কারণ, আবরার হত্যাকাণ্ডের আবহে তৈরি হওয়া গভীর আবেগের মধ্যে ছাত্ররা যা নিষিদ্ধের দাবি করেছেন, সেটা নিষিদ্ধই ছিল। ছাত্ররা সম্ভবত আইনটি জানেন না, কারণ তাঁদের ক্যাম্পাস আইনটি তাঁদের জানায়নি।

এখন থেকে ভর্তি আদেশে বোর্ড অব রেসিডেন্স অর্ডিন্যান্সের কপি গেঁথে দেওয়া উচিত। এটা নিশ্চিত করা হলে ছাত্ররা জানবেন যে তাঁরা কী শর্তে ভর্তি হলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান হলেন ডিএসডব্লিউ। বর্তমানে যিনি আছেন, তিনি ড. মিজানুর রহমান। তাঁকে বললাম, বলুন ছাত্রসংগঠনগুলো বেআইনিভাবে চলছিল। বললেন, এটা বলা কঠিন। কারণ, আমিও ছাত্রসংগঠন করতাম।

তারপর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করায় তিনি স্বীকার করলেন, এগুলো বেআইনি। তাঁকে ধন্যবাদ, তিনি যুক্তি মানলেন। বললেন, জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের উচিত ছিল বুয়েট আইনের আওতায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা উল্লেখ করা। তাঁকে বললাম, আপনাদের ভিসির ব্যক্তিকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত হিসেবে নয়, বুয়েটের আইন কী বলে, সেটা পোস্টার করে দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়ে দিন। আপনারা তাহলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের অহেতুক বিতর্ক থেকে বাঁচাবেন। অন্তত মুঠোফোনে ড. মিজানুর একমত হয়েছেন।

আর আমরা যাঁরা সাংবাদিক, তাঁরাও সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্নটি করতে পারিনি। ভিসি যখন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দিলেন, তখন সাংবাদিকদের এই প্রশ্ন করা উচিত ছিল যে যা নিষিদ্ধ, যা সনির হত্যার পরে তৎকালীন ভিসি একা নন, একাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে করেছিলেন, তা ১৭ বছরের ব্যবধানে এখন ‘নিজস্ব ক্ষমতাবলে’ চালিয়ে দিচ্ছেন কেন? তাহলে ভিসি ও তাঁর প্রশাসনের ‘সাহসী’ সিদ্ধান্তের বেলুনটা চুপসে যেত। অথচ সেটা হলো না। একই কুমিরের ছানা বুয়েট প্রশাসন দ্বিতীয়বার দেখিয়ে দিল। এর দায় অবশ্য ভিসির একা নয়। গোটা বুয়েট প্রশাসনকেই নিতে হবে।

আর অন্যদিকে ছাত্রলীগের যাঁরা বিরোধী, বিভিন্ন সচেতন গণতান্ত্রিক মহল, তাঁরা গণতন্ত্রের নামে এক মুখে বুয়েট ছাত্রদের বাহাদুরিকে শাবাশ দিচ্ছেন; অন্য মুখে বলছেন ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জায়গাটাই শুধু গোলমেলে। আবার অনেকে হাপিত্যেশ করছেন এই বলে যে মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটা ঠিক হচ্ছে কি না। অথচ এসবই বুয়েটের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। নিরেট একটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক, বুয়েটে আইন অমান্য চলবে কি চলবে না।

বুয়েট আইনের কোথাও রাজনীতি শব্দটিই নেই। আমাদের প্রচলিত আইনের কোথাও ছাত্ররাজনীতির সংজ্ঞা নেই। অননুমোদিত সংগঠন আপনা–আপনি নিষিদ্ধ। ডিএসডব্লিউ চাইলে ছাত্রলীগের মতো সংগঠনের কার্যক্রমে অনুমোদন দিতে পারে। সবার কাছে তাই অনুরোধ, বুয়েটকে আগে বুয়েট আইনে চলতে দিন। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তের বিতর্কের বেড়াজালে বুয়েটকে ভেসে যেতে দেবেন না। এই বিতর্কের ঝোড়ো হওয়া থেকে বুয়েট নিজেকে বাঁচাতে চাইলে বুয়েটকে আইন আঁকড়ে ধরতে হবে।

আইন মানলেই ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা অন্য যারাই আছে, তারা বুয়েট ক্যাম্পাসে তৎপরতা চালাতে পারবে না। ছাত্ররা সংগঠনগুলোর অফিস তুলে দিতে বলেছেন, শতভাগ সঠিক দাবি। আইন হলো ডিএসডব্লিউর লিখিত অনুমতি ছাড়া বুয়েটে সংগঠন চালানো যাবে না। এ রকম ২৯টি সংগঠন আছে। তার মধ্যে কোনো ছাত্রসংগঠন নেই। সুতরাং তাদের অফিসও থাকতে পারবে না।

সনি হত্যার আগে বুয়েটের টেন্ডার একপ্রকার ছিনিয়ে নিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতারা। বুয়েট ছাত্রদল শাখা দেখল, তাদের মুখের খাবার অন্যরা কেড়ে নেবে কেন। তাই তারা রুখে দাঁড়াল। এ নিয়েই ছাত্রদলের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হলো। আর তাতে হলে থাকা সনি তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে কৌতূহল মেটাতে গিয়ে ক্রসফায়ারে নিহত হলেন। সেই ঘটনায় যাঁরা বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাঁরা আর ক্যাম্পাসে ফিরতে পেরেছিলেন কি না, ফাঁসির হুকুম কার্যকর হয়েছিল কি না, তা সংশ্লিষ্টরা ‘অনেক পুরোনো’ ঘটনা বলে স্মরণ করতে পারে না।

 অন্য বড় খবরের আড়ালে বুয়েট চাপা পড়ার আগেই প্রতিটি অননুমোদিত কমিটির সদস্যদের শোকজ করুন। আবরার খুন ও ছাত্ররাজনীতিবিষয়ক তর্ক থেকে অবৈধ সাংগঠনিক তৎপরতা বন্ধের বিষয়টিকে পৃথক করুন।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]