অ্যাডহক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত সুফল দেয় না

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ ছাত্রদের পক্ষ থেকে ‘ছাত্ররাজনীতি’ নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। অনেকে সে দাবি সমর্থন করেন, কেউ করেন বিরোধিতা, কেউ দুই পক্ষের মাঝামাঝি অবস্থান নেন। তাঁরা একটি ‘তবে’ যোগ করে বলেন, ছাত্ররাজনীতি রাখা যেতে পারে। ‘ছাত্ররাজনীতি’র উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে অমূল্য বক্তব্য দিয়েছেন কেউ কেউ। কেউ বলেছেন, ও জিনিস না থাকলে দেশ রসাতলে যাবে। জঙ্গিতে ভরে যাবে প্রজাতন্ত্র। যেন জঙ্গি ঠেকাতে জঙ্গি চাই।

ছাত্ররাজনীতি কী? তার যদি সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকে, তাহলে তা চালু রাখতে চাওয়া অথবা বন্ধ করতে মনস্থ করা অর্থহীন। ব্যক্তিগতভাবে ছাত্ররাজনীতি বলতে আমি কী বুঝি এবং তা ঠিক কি বেঠিক, যাচাই করতে কয়েকজন স্বনামধন্য বিশিষ্টজনকে ছাত্ররাজনীতির সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করেছিলাম। সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না হোক, অন্তত ছাত্ররাজনীতি বলতে তাঁরা মোটের ওপর কী বোঝেন। আট-দশজনের প্রত্যেকেই যা বললেন, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি।

ছাত্র এক জিনিস, রাজনীতি আরেক বস্তু। ছাত্রের একটি চমৎকার সংজ্ঞা আমাদের ছেলেবেলায় কেউ একজন বোর্ডে লিখে আমাদের পড়ার ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। প্রাচীনকালের সংস্কৃত পণ্ডিতদের দেওয়া সেই সংজ্ঞার কথাগুলো আমার আজও মনে আছে। ‘কাকচেষ্টাঃ বকোধ্যানঃ সারনিদ্রা তথঞ্চঃ/স্বল্পাহারঃ গৃহত্যাগঃ ছাত্রনং পঞ্চলক্ষ্য’। একজন ছাত্রের বৈশিষ্ট্য পাঁচটি: জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা তার কাকের মতো, বিষয়বস্তু নিয়ে ধ্যান করবে বকের মতো, কুকুরের মতো ঘুমাবে অল্প, তার আহার পরিমিত এবং বিদ্যা অর্জনের জন্য গৃহত্যাগ করে উপযুক্ত শিক্ষকের কাছে যেতে হবে। আধুনিক কালে যেমন বাড়িতে মা–বাপ ছেড়ে অনেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ছাত্রাবাসে থাকেন, আগের দিনে ছাত্ররা যেতেন ওস্তাদ বা গুরুর বাড়িতে। তবে সেকালে গুরুগৃহে গিয়ে কেউ লাশ হয়ে ফিরতেন না। কঠিন অধ্যবসায়ের দ্বারা বিদ্যা অর্জন করে স্বগৃহে ফিরে যেতেন। কারণ, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’।

রাজনীতি বলতে কী বোঝায়, তা বাঙালি হাড়ে হাড়ে বোঝে। সুতরাং তার নতুন কোনো সংজ্ঞার দরকার নেই। রাজনীতি প্রতিটি শ্রেণি ও গোত্রের জন্য আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত করার বস্তু নয়। ছাত্রদের জন্য এক রকম রাজনীতি, শিক্ষকের জন্য আরেক রকম, মুটে-মজুরের জন্য অন্য রকম, উপসম্পাদকীয় লেখকদের জন্য ভিন্ন প্রকার, গৃহবধূদের জন্য অন্য রকম, ইয়ের দালালের জন্য আরেক রকম হতে পারে না।

জনকল্যাণকর রাজনীতি এক মহৎ বিষয়, আর পলিটিকস আরেক বস্তু। বাঙালি রাজনীতির চেয়ে পলিটিকস ভালো বোঝে। বাঙালি তাদের পরিবারে ভাইবোন-ভাবি-দুলাভাইদের মধ্যে পলিটিকস করে, তারা ভিলেজ পলিটিকস করে গ্রামের এক পাড়ার সঙ্গে আরেক পাড়ার ঝগড়া বাধায়, তারা কাজকর্ম ফেলে অফিস-আদালতে বস ও সহকর্মীদের বিরুদ্ধে পলিটিকস করে; লেখাপড়া অবহেলা করে বাঙালি ছাত্ররা পলিটিকস করবে না তো কী করবে? তারা লাইব্রেরি কক্ষে বইয়ের পাতায় নিমগ্ন না থেকে নিজেদের তৈরি টর্চার সেলে প্রতিপক্ষকে বধ করার ষড়যন্ত্র ছাড়া প্রগতিশীল জনকল্যাণকর রাজনীতি করবে, তা ভাবা যায় না।

পশ্চিমের যেসব দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে বহুদূর এগিয়ে গেছে, সেসব দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বলে কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। সেখানে গণতান্ত্রিক রাজনীতি আছে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো কোনোটিতে আছে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন। সেসব দেশে ছাত্ররাজনীতির প্রকোপ নেই, যা আছে তা হলো স্টুডেন্ট মুভমেন্ট—ছাত্র আন্দোলন। তবে সে ছাত্র আন্দোলন হপ্তায় হপ্তায় হয় না। ১০-২০ বছর পর একবার হয়। যেমন একবার হয়েছিল ১৯৬৮-তে। ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে সেই ছাত্র আন্দোলন। প্রগতিবাদী দার্শনিক-বুদ্ধিজীবীরা তাতে সমর্থন দেন। বিশ্ববিখ্যাত অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তাঁদের সেই সাক্ষাৎকার বই আকারে বের হয়। আমাদের উনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনে ইউরোপের ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব ছিল উনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন।

যে মাটিতে স্টুডেন্ট পলিটিকস আছে, সেখানে তাদের ওস্তাদ বা শিক্ষকেরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতেই পারেন না। শিক্ষকতা অতি মর্যাদার পেশা। বাঙালি মর্যাদার চেয়ে ক্ষমতাবানের অনুগত চাকর হওয়া বেশি পছন্দ করে। একজন অধ্যাপক শুধু তাঁর ছাত্রদের শ্রদ্ধাভাজন নন, সমাজের সব মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু বাঙালি সব মানুষের শ্রদ্ধাস্পদ হওয়ার চেয়ে ক্ষমতাবান প্রভুর ভৃত্য হওয়াকে বেশি মূল্য দেয়। তাতে যদি খুদকুঁড়োপ্রাপ্তি ঘটে, তা-ও ভালো। অবশ্য যাঁরা যোগ্যতায় নয়, হাতে-পায়ে ধরে চাকরি পান, তাঁদের প্রভুর প্রতি দাসোচিত অনুগত না থাকাই অস্বাভাবিক। সে জন্য শিক্ষকদের পলিটিকস না করে উপায় নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কারও বয়সই কুড়ির কম নয়। তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক। রাজনীতি করার ইচ্ছা থাকলে তাঁরা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের ইমারতে যেতে পারেন, নয়াপল্টনের হুজরাখানায় যেতে পারেন, মগবাজারের কোনো বাড়িতেও যেতে পারেন। তাতে বাধা নেই। সে ক্ষেত্রে তাঁরা স্বাধীন। কিন্তু রাজনৈতিক দলের অ্যাজেন্ডা ক্যাম্পাসে বাস্তবায়ন করার মৌলিক অধিকার তাঁদের নেই। সাহিত্যিক হুমায়ুন কবির বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি করে মন্ত্রী হন। আমাদের শিক্ষকদের কেউ ইচ্ছা করলে চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিলে কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু শিক্ষক লাউঞ্জকে কলুষিত করবেন নষ্ট দলীয় রাজনীতির নোংরায়—তা প্রত্যাশিত নয়।

ষাট ও সত্তরের দশকে একজন ছাত্রনেতা হয়ে উঠতেন তাঁর নিজের যোগ্যতায়। তখন দলের নেতারা তাঁদের সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতেন। গত ৩০-৩৫ বছরে নিজের যোগ্যতায় একজনও ছাত্রনেতা হয়ে ওঠেননি। কেউ যেমন সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক নিযুক্ত হন, সহযোগী সংগঠনের ছাত্রনেতারাও সরকারি অথবা বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা কর্তৃক মনোনীত ও নিযুক্ত হন। ভোটাভুটি নেই, সাধারণ ছাত্রদের অংশগ্রহণ ও সমর্থন নেই, এক সকালে তাঁরা পত্রিকায় দেখলেন অমুকে তাঁদের নেতা। সেই নেতাকে সালাম ও শুভেচ্ছা-স্বাগত না জানালে চড়-থাপ্পড়, ফ্লাইং কিক শুধু নয়, কান ধরে ওঠবসও শুধু নয়, আরও ভয়াবহ নির্যাতন অনিবার্য।

আজ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অপার ক্ষমতার অধিকারী। তাঁদের যেন একেকটি সাংবিধানিক পদ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের সভাপতি যেন ‘সুপারনিউমেরারি ভাইস চ্যান্সেলর’। তাঁর কাছে নত হয়ে থাকতে হয় উপাচার্যকে—প্রভোস্ট ও হাউস টিউটর তো ছার। প্রতিষ্ঠানের একজন ছাত্র পৈশাচিক শারীরিক নির্যাতনের ফলে নিহত হয়েছেন, তাঁর মরদেহটি উপাচার্য দেখতে যাবেন কি যাবেন না, তা নির্ভর করে ছাত্রসংগঠনের নেতার অনুমতির ওপর।

যে ছাত্ররাজনীতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত ছাত্রনেতাকে সুপারনিউমেরারি ভাইস চ্যান্সেলরের ক্ষমতা দেয়, সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সিপাহসালার বানায়, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়, সেই ছাত্ররাজনীতি দিয়ে জাতির কী হবে? সেটা সত্যিকারের মেধাবী ও চরিত্রবান সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করেই ক্যাম্পাসে পলিটিকস নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সরকার বা কর্তৃপক্ষকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো পক্ষের চাপে অ্যাডহক ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। মগজ ধোলাই করা সুবিধাভোগী কথিত ছাত্রনেতাদের কী বাসনা, তা বিবেচ্য নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো লাখ লাখ শিক্ষার্থীর নিম্ন ও মাঝারি আয়ের অভিভাবকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক