সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের হাতে সমাধান নেই

অর্থনৈতিক সংকটে অতিষ্ঠ তরুণেরা দেশে দেশে নেমেছে বিক্ষোভে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে চলমান সরকারবিরোধী প্রতিবাদের একটি মুহূর্ত। ছবি: এএফপি
অর্থনৈতিক সংকটে অতিষ্ঠ তরুণেরা দেশে দেশে নেমেছে বিক্ষোভে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে চলমান সরকারবিরোধী প্রতিবাদের একটি মুহূর্ত। ছবি: এএফপি

কোথায় হংকং আর কোথায় লেবানন বা চিলি বা হাইতি। কোনো কিছুতেই তাদের মিল নেই। কিন্তু প্রবাদকথিত সেই জনগণ, যারা কিনা ইতিহাস তৈরি করে, অন্যায়-অনিয়ম রুখে দাঁড়ায়; তাদের দেখা পেতে হলে এখন এসব দেশের দিকে তাকাতে হবে। হংকংয়ে মাসখানেকের বেশি কাল ধরে চীনের কালাকানুনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে চলেছেন তরুণেরা। লেবাননে সপ্তাহজুড়ে গণবিক্ষোভে সরকার পড়ো পড়ো। চিলির কয়েকটি প্রদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে, নিহত হয়েছেন সাতজন। হাইতিতে গণবিদ্রোহে নিহত হয়েছেন ২০ জন। এসব দেশের কোনো সরকারই নিরাপদ বোধ করছে না। হংকং ছাড়া বাকি দেশগুলোয় গণ–অসন্তোষের কারণটা অর্থনৈতিক। 

হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারের ওপর কর বসানোয় ফুঁসে উঠেছে লেবানন। তারপর চলে এসেছে দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের মানিকজোড়কে তাড়ানোর স্লোগান। চিলির বিক্ষোভ চলছে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা আসলে চরমভাবে অতিষ্ঠ। জীবন চালানোর ব্যয় অসহ্য হয়ে উঠছে। হাইতিতে সরকারবিরোধী দাঙ্গার উপলক্ষ সরকারের দুর্নীতি ফাঁস হওয়ার ঘটনা। অর্থনৈতিক বাস্তবতা এসব দেশের মানুষকে ঠেলে দিয়েছে আন্দোলনের দিকে। 

লেবাননের পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে ২০০৫ সালের তথাকথিত সিডার বিপ্লবের মতো। সে সময় ধনকুবের প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি রহস্যজনকভাবে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান। এর প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়ার বাহিনীকে লেবানন ছেড়ে চলে যেতে হয়। আর এবার সব দল-মতের মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে রফিক হারিরির পুত্র বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির বিরুদ্ধে। তাঁদের সব আক্রোশ সরকারের বিরুদ্ধে, তাঁদের কোলে থাকা ধনী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে। করবে না-ই বা কেন! তরুণদের বড় অংশটাই বেকার। গার্ডিয়ান পত্রিকার সংবাদে জানা যাচ্ছে এ রকম কয়েকজন তরুণের কথা। 

২১ বছর বয়সী হুসেইন এল হেক বলছেন, ‘সুস্বাদু খাবার যেন বিলাসিতা। কোনো রাজনীতিবিদকে তো দেখিনি তাঁর বেতন ত্যাগ করতে। তাঁরা কেবল চুরিই করছেন না, চুরি করছেন নির্লজ্জভাবে। যা করছেন তার মানে আক্ষরিকভাবেই তাঁরা জনগণের জীবনে ক্যানসারের মতো। সব রাজনীতিবিদই হিসাবের চাইতে বেশি দিন (ক্ষমতায়) থাকছেন এবং তাঁরা বিদায় হলেও তাঁদের সন্তানদের মোকাবিলা করতে হয় আমাদের। আমার দিন চলে না। প্রেম করার সামর্থ্য নেই, বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, নিজের দেখভাল করারও উপায় নেই। তাই আমরা প্রতিবাদ করছি। যাঁরা আমাদের খাবার দিতে পারেন না, তাঁদের আনুগত্য কেন করব?’ 

মানুষের হাতে টাকা নেই। যা আছে, তার মান ডলারের বিপরীতে পতনশীল বিধায় ক্রয়ক্ষমতার পতন ঘটছে। এই সংকটের শুরু রফিক হারিরির আমলে নেওয়া বিপুল ঋণের কারণে। হারিরি পরিবার এবং তাঁদের ইয়ার-দোস্তরা দেশের সব সম্পদের মালিক। বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোও তাঁদেরই দখলে। দুর্নীতি ও লুণ্ঠনে তৈরি হওয়া এই ধনিক শ্রেণিটিকে মানুষ ‘হারিরি শ্রেণি’ বলে ডাকে। এই শ্রেণির নেতা প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি এ রকম ক্রান্তিকালেও দক্ষিণ আফ্রিকার এক সুপার বিকিনি মডেলকে তাঁর সঙ্গে প্রেমের বিনিময়ে ১৬ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দেন বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। 

অথচ ১৭ বছর বয়সী শেরবেল অ্যান্টনের মনে বিষাক্ত হতাশা, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য আমরা লেবাননেই থাকতে চাই। কিন্তু এসব দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ যদি এখানে থাকে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ শেষ।’ 

পিতা-পুত্র মিলে হারিরি পরিবার ৩০ বছর যাবৎ লেবানন শাসন করে আসছে। পরিবারটি সৌদি-আমেরিকার খুব ঘনিষ্ঠ। এদের বিরুদ্ধেই উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত লেবানন ও তার রাজধানী বৈরুত হাতে হাত মিলিয়েছে। শিয়া-সুন্নি-খ্রিষ্টানে বিভক্ত সমাজ এক মিছিলে শামিল হয়েছে। এ রকম অভূতপূর্ব ঐক্যের মধ্যে হতাশাজনক জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক বলে দাবিদার হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লা। তিনি জনগণের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়েও সরকারের পতনের বিপক্ষে। কেননা, লেবাননকে দুর্দশা থেকে উদ্ধারে ফ্রান্স যে ১১ বিলিয়ন ডলারের তহবিল দেবে বলেছে, হারিরি ছাড়া অন্য কাউকে তারা মেনে না–ও নিতে পারে। 

লেবানন যেভাবে সব রঙের রাজনীতিবিদের প্রতি আস্থা হারিয়ে রাস্তায় নেমেছে, চিলি ও হাইতিতেও চলছে একই রকম মরিয়াপনা। যে মধ্যবিত্ত সমাজকে ভাবা হয় সমাজের শিরদাঁড়া, যারা নাকি পরিবর্তনের রাখাল, তারা আর টিকতে পারছে না। খুব দ্রুত তারা দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে বলে দরিদ্রদের সঙ্গে তাদের ক্ষোভের মিতালি হচ্ছে। চিলির মধ্যবিত্তও আমাদেরই মতো। চিকিৎসা, শিক্ষা ও সরকারি সেবা কিনতে গিয়ে ফতুর হচ্ছে। এর মধ্যে মেট্রোরেলের ভাড়া বাড়া যেন এই সামাজিক মেরুদণ্ডের ওপর আঘাত। ফলত খেপে উঠেছে ছাত্ররা। তাদের ঠেকাতে রাজধানীতে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। 

দুর্নীতি ও দারিদ্র্য হাইতিবাসীকে রাস্তায় নামিয়েছিল মাসখানেক আগে। এর মধ্যেই বিস্ফোরক সংবাদ প্রকাশিত হলো যে রাষ্ট্রীয়ভাবে তেল কিনতে গিয়ে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার লোপাট হয়ে গেছে। আন্দোলন দমনে শুধু সাধারণ তরুণদেরই না, হত্যা করা হয়েছে তিন সাংবাদিককেও। 

এসব দেশের পরিস্থিতি আরব বসন্তের সূচনাকারী দেশ তিউনিসিয়ার মতো। মানুষ আর তাদের বর্তমানকে নিয়ে চলতে পারছে না, শাসকেরাও আর আগের কায়দায় শাসন করতে পারছেন না। এমন অবস্থাতেই পরিবর্তন হয়, সরকার ও ব্যবস্থার বদল হয়। কিন্তু সবখানেই দেখা যাচ্ছে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির শূন্যতা। অবস্থাটা এমন, জনগণের যেন জনগণ ছাড়া আর কেউ নেই। রাজনীতি থেকে আর বিকল্প আসছে না। আন্দোলন হচ্ছে একক কোনো নেতা ছাড়াই। 

এককথায়, হংকং ছাড়া বাকি তিন দেশে মানুষের মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে দেশগুলোর বিদ্যমান কাঠামো; আবার নতুন ব্যবস্থাও আসছে না। এই কাঠামোগত অসন্তোষ দেশে দেশেই ফেনায়িত হচ্ছে, কখন কোথায় জনগণ ফেটে পড়বে তা বলা না গেলেও, এ ধরনের সিরিজ গণবিক্ষোভ দেশে দেশে আরও দেখা যেতে পারে। সমস্যা হলো রাষ্ট্র-রাজনীতি দেশীয় হলেও সংকটের অর্থনৈতিক জালটা বৈশ্বিক। গরিবি আর স্বৈরতন্ত্র একসঙ্গেই যখন বাড়ছে তখন মধ্যবিত্তরা নেতাদের মুখোশ খুলে পড়তে দেখছে। নেতারাও দেখছেন, সম্পদ বানাতে গিয়ে বণ্টনের দিকে অনেক কাল নজর দেওয়া হয়নি। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে পরিত্যাগ করা হয়েছে জনগণকে। 

এমনই যখন বিকল্পহীনতা, তখন সুদানে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টকে হটালেও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয় সামরিক-আমলাতন্ত্র। আপসহীন বামপন্থী বা নতুন ধারার দলের অভাবে রাজনীতি পরিণত হয়েছে গোলকধাঁধায়। বিপন্ন মানুষ আন্দোলন করে বটে কিন্তু ফিরে আসে একই কুমিরের ছানা। সংকটের জন্য দায়ী যাঁরা, সমাধান তাঁদের হাতে নেই। বঞ্চিত শ্রেণিগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে যদি নতুন রাজনীতির ভিত না গড়তে পারে, তাহলে আশা কম। 

ফারুক ওয়াসিফ : লেখক ও সাংবাদিক