বুয়েটকে শ্বাস নিতে দিন

যে ক্ষমতাবলে বর্তমান উপাচার্য ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ করলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আরও আগেই ব্যবস্থা নিলে হয়তো আবরারকে প্রাণ হারাতে হতো না। ছবি: প্রথম আলো
যে ক্ষমতাবলে বর্তমান উপাচার্য ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ করলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আরও আগেই ব্যবস্থা নিলে হয়তো আবরারকে প্রাণ হারাতে হতো না। ছবি: প্রথম আলো

আমি বুয়েট ক্যাম্পাসে থাকি। যে বাসাটায় আমরা থাকি তার আশপাশেই ছাত্রছাত্রীদের হলগুলো। কান পাতলেই শোনা যায় তাদের কোলাহল। কখনো টিভি রুমে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা দেখার হইচই, কখনোবা রাতের সাময়িক বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বুয়েটের চিরাচরিত নিয়ম পালনে ছাত্রদের সম্মিলিত চিৎকার। এসব নিয়েই আমাদের ক্যাম্পাসের জীবন। আবরারের নির্মম হত্যাকাণ্ডে সেই চেনা ক্যাম্পাস হঠাৎ করে বদলে গেল। ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছে, হলের প্রভোস্টকে আটকে রেখেছে, ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছে, শিক্ষকেরা কাঁদছেন, অ্যালামনাইরা ছুটে এসেছেন—চারদিক গুমোট, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

যাঁরা বুয়েট ক্যাম্পাসে থাকেননি তাঁরা হয়তো বুঝবেন না এই ছোট্ট নিরিবিলি পড়ুয়া ক্যাম্পাসে কখনোই সেভাবে সরব ছাত্ররাজনীতি ছিল না। ছাত্ররা মূলত লেখাপড়া নিয়ে থাকে। ‘ভালো ছাত্ররা’ একটু আত্মকেন্দ্রিক আর ভীরু হয়– বুয়েটেও হয়তো তাই। এই নিরীহ ছাত্ররাই দুটি অবিশ্বাস্য কাজ করেছে। কয়েকটি ছেলে তাদেরই এক সতীর্থকে হিংস্রভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আর অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছে হত্যা, সন্ত্রাস, নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে, বিচার দাবিতে, জীবনের নিরাপত্তার দাবিতে। এই প্রতিবাদে মিছিল ছিল, স্লোগান ছিল, ঘেরাও ছিল। কিন্তু ভাঙচুর, আক্রমণ, অসম্মান, গালিগালাজ ছিল না। কারও চামড়া তুলে নেওয়ার হুমকি ছিল না। তারা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অহিংস ঐক্যের শক্তি। বারবার মনে পড়ছিল এদের চেয়েও কম বয়সী আরেক দল ছেলেমেয়েদের কথা, যারা রাস্তায় নেমেছিল নিরাপদ সড়কের দাবিতে। এত কষ্ট আর অসহায়ত্বের মধ্যেও অভিভূত হয়েছি তাদের গ্রাফিতি ও পথনাটকের মতো অভিনব প্রতিবাদের ভাষা দেখে। মনে হয়েছে, এটিই হোক ছাত্ররাজনীতির নতুন ধারা। কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন না থাকলেও চলবে। 

কিছু ক্লাব আছে— বিতর্ক, সাহিত্য, নাটক, আবৃত্তি, ফটোগ্রাফি, বিজ্ঞান এ ধরনের কিছু চর্চা হয়। তবে ছাত্ররা রাজনীতিসচেতন। আবরারের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকেও সেটি বোঝা যায়। যাঁরা বলছেন প্রকৌশল শিক্ষার পাঠ্যক্রমে আরও মানবিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, তাঁদের একটু ভাবতে বলি—সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, পরমতসহিষ্ণুতা এসব কি ছাত্ররা পাঠ্যক্রম থেকে শেখে? নাকি শেখে নির্লোভ, নির্ভীক, অনুসরণীয় রোল মডেলদের দেখে; আমাদের সমাজে, জাতীয় নেতৃত্বে, শিক্ষাঙ্গনে যার খরা চলছে? একবার কি ভাববেন কোন রোল মডেলদের দেখে আমাদের ছাত্ররা কী শিখছে?

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে। ছাত্রদের সাহসী ভূমিকা অনেক সময়েই জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত ও চালিত করেছে। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ, কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন—এসব ক্রান্তিকালে ছাত্ররা ছিল প্রথম সারিতে সক্রিয়। বুয়েটের ক্ষুদ্র পরিসরেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বুয়েটের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের (ইউকসু) নেতারা একসময় ছাত্রদের মাঝে প্রায় প্রবাদতুল্য আস্থা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু জাতীয় তিন রাজনৈতিক জোটের আশা জাগানিয়া রূপরেখা এবং সাহাবুদ্দীন সরকারের বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও নব্বই–পরবর্তী ছাত্ররাজনীতিতে আদর্শিক বিচ্যুতি ঘটতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের অধিকার সংরক্ষণের চেয়ে কিছু ছাত্রনেতা দলীয় ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত হওয়ার দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। কেন সেটি ঘটেছে সেই বিশ্লেষণে নাই গেলাম এবং এটিও বলে রাখা ভালো, যে ক্ষমতার লঙ্কায় যায় সে-ই নিপীড়ক রাবণ হয়ে যায় না। তবে বুয়েটে দৃশ্যমান ফলাফল ও বাস্তবতা হচ্ছে, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ছাত্রসংগঠনেরও ক্ষমতায়ন হয়েছে। এই ক্ষমতা তারা ব্যবহার করেছে কখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রভাবিত করে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য, কখনো প্রতিযোগী ছাত্র সংগঠনকে শায়েস্তা করে নিজেদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ করার জন্য, কখনো ভিন্নমতের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের জন্য।

আবরার ফাহাদ। ফাইল ছবি
আবরার ফাহাদ। ফাইল ছবি

তাহলে আমরা কী করছিলাম? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? বুয়েটের মাননীয় উপাচার্য? এসব অন্যায়কে আমরাও তো দিনে দিনে বাড়ার সুযোগ দিয়েছি। কখনো ক্ষমতাসীনদের ভয়ে, কখনো তাদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য। এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। বুয়েটের উপাচার্য প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর অনুমতি ছাড়া বুয়েটে কোনো কিছুই নড়ে না। একটি কমোড পরিবর্তন করতেও তাঁর অনুমোদন লাগে বলে শুনেছি। সাবেক একজন উপাচার্যকে বলতে শুনেছি, ‘উপাচার্য চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রিও করতে পারেন’। যে ক্ষমতাবলে বর্তমান উপাচার্য ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ করলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আরও আগেই ব্যবস্থা নিলে হয়তো আবরারকে প্রাণ হারাতে হতো না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা অন্যদের জন্য অপেক্ষা করেননি। পরিস্থিতির সংবেদনশীলতা বুঝতে পেরে নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন। আবরারের ফেসবুক স্ট্যাটাসটিতে তাঁরই ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তিনি এই ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন। তথ্য আর যুক্তি দিয়ে এই ধরনের ভিন্নমতকে খণ্ডানোর চেষ্টা করেছেন। এটিই সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, ভিন্নমত থাকলেই শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় কেবল উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ নয়, মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর স্বাধীন মত প্রকাশেরও ক্ষেত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন স্বনামখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা, শিক্ষাঙ্গন, ছাত্রদের অধিকার এমনকি জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুতেও ছাত্রদের আলোচনা এবং বিতর্ক চলে এই উন্মুক্ত ক্ষেত্রে। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা রাজনীতিসচেতন। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন নেই। ছাত্রদের ক্যাম্পাসের কার্যক্রম চলে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। ছাত্রদের নির্বাচিত ইউনিয়ন কিংবা সিনেটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে তাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। আমরা কি বলতে পারি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির পরিবেশ নেই, কিংবা ক্যাম্পাসকে ‘বিরাজনীতিকরণ’ করা হয়েছে? বুয়েটের বাস্তবতায় বলি, চলমান স্ব-সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের মূল প্রতিবাদ ছাত্রদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তারা যে ‘সাংগঠনিক রাজনীতি’ বন্ধ করার দাবি করেছে তার কারণ তারা দেখেছে এই নিপীড়ক এবং সন্ত্রাসীদের একটি বড় অংশ দলীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসেছে। তারা এও সচেতন যে দলীয় ছাত্র সংগঠনের অনুপস্থিতিতে, শঙ্কিত বোদ্ধারা যেটিকে ‘বিরাজনীতিকরণ’ বলছেন, যেন সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান না ঘটে। এই আশঙ্কা নির্মূল করতে হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সচেতন ও সক্রিয় থাকা প্রয়োজন।

আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যা বুঝি, বুয়েটের ছাত্রদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনসমূহের বুয়েট শাখা—অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও—বিলোপ করে ছাত্রদের দলীয় ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন এবং প্রশাসনে তাদের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত ইউকসু এবং হল সংসদের নির্বাচন আয়োজন করা গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কুফল নিয়ে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শুনতে পাই। আশা করি, সম্মানিত বিশ্লেষকেরা বুয়েটের বাস্তবতায় ‘ছাত্ররাজনীতি’ এবং ‘ছাত্রসংগঠনের ছদ্মবেশে দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহার’; এই দুটির পার্থক্য বিবেচনা করবেন। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিমিতিবোধ এবং পরিপক্বতা আশা জাগায়, এরাই একদিন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির সঠিক পথ খুঁজে নেবে। বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কাছে সবিনয় নিবেদন, ততদিন পর্যন্ত এই ক্ষুদ্র বুয়েটকে রেহাই দিন, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে দিন, বাঁচতে দিন।

ড. মুহম্মদ শাহ্‌ আলম খান: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]