ক্রিকেটে কেঁচো খুঁড়তে বেরোচ্ছে যে কেউটে

ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবি পেশ এবং সঙ্গে সঙ্গেই ধর্মঘটে যাওয়ার ঘোষণা নিয়ে বেশ একটা ঝড় বয়ে গেল বাংলাদেশে। বিসিবি সভাপতি সংবাদ সম্মেলন করে নিজের গোস্সার কথা জানিয়ে দিলেন। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আলোচনার টেবিলে উভয় পক্ষ আর সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসের প্রেক্ষাপটে ধর্মঘটের অবসান। বাংলাদেশ খেলতে যাচ্ছে ভারতে।

কিন্তু ক্রিকেটাররা অন্তত একটা মারাত্মক অভিযোগ, যা অনেক দিন থেকেই সবার জানা, তা সামনে এনেছেন। সাকিব আল হাসান বলেছেন, ঢাকার লিগের কোন ম্যাচে কোন দল জয়লাভ করবে, খেলার আগে থেকেই সেটা সবাই জানে।

এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। প্রথম আলোর গত বছরের লেখা পড়ুন, ‘কয়েক বছর ধরে অনিয়মই নিয়ম ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে। অর্থ আর পেশিশক্তির কাছে হেরে ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট এখানে চূড়ান্ত অভদ্র। মাঠের খেলার চেয়ে বড় ভোটের স্বার্থ। পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং আর পাতানো ম্যাচ দেখে বড় হচ্ছে নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। চলতি মৌসুমে প্রথম ও তৃতীয় বিভাগ লিগের বেশ কয়েকটি ম্যাচে মাঠে উপস্থিত থেকে এবং খেলোয়াড়, ক্লাব কর্মকর্তা, ম্যাচ রেফারি, আম্পায়ার ও স্কোরারদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকার ক্রিকেটের ভয়াবহ এক চিত্র তুলে ধরেছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি তারেক মাহমুদ। (প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর ২০১৮)।

তারেক মাহমুদ লিখেছেন, ‘প্রথম ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে নির্দিষ্ট কিছু ক্লাবকে অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দিতে কাজ করে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী, যেটি বিসিবির প্রভাবশালী পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিককে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় বলে অভিযোগ। এই গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ বিসিবি নির্বাচনে অবস্থান শক্তিশালী রাখতে যত বেশিসংখ্যক নিজেদের ক্লাবকে লিগের পয়েন্ট তালিকার ওপরের দিকে রাখা। ভোটব্যাংক সমৃদ্ধ হয় তাতে। আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি ও স্কোরারদের প্রভাবিত করে অন্যায়ভাবে ম্যাচ জেতার চেষ্টার এটাই কারণ। মল্লিক অবশ্য এই অভিযোগকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।’

প্রিমিয়ার লিগ এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট মিলিয়ে ৭৬টি ক্লাবের প্রায় ৬০টি ক্লাবই আছে একই ছাতার নিচে। ক্লাবের কমিটিতে যাঁরাই থাকুন না কেন, এসব ক্লাব চলে বিসিবির ১৩-১৪ জন পরিচালকের যৌথ অর্থায়নে। বিসিবির বিভিন্ন সাব-কমিটির লোকজনও আছেন সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলোর সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক স্বীকার করেছেন, ‘যা-ই হচ্ছে, এই ১৩-১৪ জন পরিচালকের সম্মতি ও সমর্থন ছাড়া কিছু হচ্ছে না।’

খেলোয়াড়দের ১১ দফা, তার সঙ্গে আরও দুই দফা দাবি পেশ, ধর্মঘট আহ্বান, ধর্মঘট প্রত্যাহার ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ নয়! এটা হওয়া উচিত মধুর কিংবা তিক্ত আরম্ভ। একটা আগাপাছতলা ক্লিনজিং অপারেশন লাগবে ক্রিকেটে এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির পর ক্রীড়াঙ্গনে শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজনীয়তা এখন সবাই উপলব্ধি করছেন।

আমরা যারা খেলার ভক্ত, ক্রিকেটের সমর্থক, বাংলাদেশের বিজয় দেখতে চাই, তারা বাইরে থেকে কত হা-হুতাশ করি, একেকটা ম্যাচ নিয়ে কত আমাদের মাতামাতি! টেবিলে রাজা-উজির মারি, চুলচেরা বিশ্লেষণ করি। কিন্তু গাছের আগায় পানি দেওয়া হচ্ছে না কেন তা নিয়ে আমরা প্রাণপাত করি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে গাছের গোড়াই কাটা। দেশের অন্য বহু অঙ্গনের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও চলছে নৈরাজ্য, পেশিতন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতা। যিনি যে খেলার সঙ্গে কোনো দিনও যুক্ত ছিলেন না, তাঁকে বসানো হচ্ছে সেই খেলার ফেডারেশন বা বোর্ডের সর্বোচ্চ পদে। নির্বাচন হয় না। গণতন্ত্র নেই। আবার ভোট থাকাও বিপজ্জনক। যেটা হয়েছে ক্রিকেটে। প্রথম আলো অনলাইনে ২৩ অক্টোবর প্রকাশিত মারুফ মল্লিকের লেখায় সেটা স্পষ্ট, ‘দেশের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ একেবারে শেষ করে দিয়েছে বিসিবির নেতৃত্ব নির্বাচনের রাজনীতি। ঢাকা প্রিমিয়ারের সুপার লিগে ওঠা ছয়টি দলের দুটি করে ভোট থাকে বিসিবির নির্বাচনে। এই ছয়টি দলই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজেদের ছয়টি দলকে সুপার লিগে ওঠাতে বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা হস্তক্ষেপ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।’

বিসিবির সভাপতি নিজেও একটা ক্লাবের সভাপতি। তারেক মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘প্রথম বিভাগে আম্পায়ারদের প্রভাবিত করে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে ওল্ড ডিওএইচএস স্পোর্টিং, উদয়াচল, কালিন্দী ক্রীড়াচক্র, ঢাকা ক্রিকেট একাডেমি, ইন্দিরা রোড ক্রীড়াচক্র, অ্যাক্সিওম টেকনোলজিস, শেখ জামাল ক্রিকেটার্স ও মোহাম্মদপুর ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে উদয়াচলের সভাপতি বিসিবিপ্রধান নাজমুল হাসান।’

যেকোনো পদ্ধতিকে দূষিত করার, ধ্বংস করার এক অপূর্ব ক্ষমতা আছে আমাদের। আমরা নির্বাচনকে ধ্বংস করি, গণতন্ত্রকে পরিণত করি নিপীড়নতন্ত্রে, স্বেচ্ছাতন্ত্রে, দুর্নীতির যন্ত্রে। আমাদের ক্রীড়াক্ষেত্রেও আমরা তা করেছি। ক্রীড়া ফেডারেশন, স্থানীয় জাতীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোয় আমরা এই সবই করছি। আর আছে দুর্নীতি। নানা ধরনের দুর্নীতি।

মারুফ মল্লিক আরও লিখেছেন: ‘বিসিবির বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ফিসফাস হতো এত দিন। এবার প্রকাশ্যেই চলে আসছে অনেক কিছু। বিসিবি এখন অনেকেরই আখের গুছিয়ে নেওয়ার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো পরিচালক বেনামে কোম্পানি খুলে বিসিবির কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। বিপিএলের গ্রাউন্ডস অ্যান্ড অফিশিয়াল স্পনসরশিপ যৌথভাবে পেয়েছিল কে স্পোর্টস ও ঢাকা কমিউনিকেশনস। ঢাকা কমিউনিকেশনসের সঙ্গে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া জড়িত বলে খবর বেরিয়েছে। এই লোকমান হোসেন এখনো বিসিবির পরিচালক। কদিন আগেও যাঁকে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান ও প্রভাবশালী পরিচালকদের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা গেছে, ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়ে সেই লোকমান যেন হাসি কেড়ে নিয়েছেন পুরো বোর্ডের!’

২০১৬ সালে টিআইবি ক্রিকেটের দুর্নীতি এবং দুর্নীতি রোধে করণীয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তখনকার খবরে বলা হয়েছিল, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালনায় সুশাসনের ঘাটতি আছে বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালনা কাঠামোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি প্রতিরোধে যথাযথ আইনের অভাবসহ ৯ ধরনের ঘাটতি চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।’ (সমকাল, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)।

সাকিব আল হাসানদের ১১ দফা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসের মধ্যে ঘরোয়া লিগে আগে থেকে ফল ঠিক করে রাখা সমস্যার সমাধানের আশ্বাসও নিশ্চয়ই আছে। আমাদের ঘরোয়া লিগে কত যে অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর কাণ্ড ঘটে গেছে, আমরা খবরের কাগজে পড়েছি। এক ওভারে ৮৭ রান দিয়েছিলেন এক বোলার, অন্যায় সিদ্ধান্তের নজিরবিহীন প্রতিবাদের মাধ্যমে একটা নজির স্থাপন করতে।

আমরা বলি, আমাদের পাইপলাইনে খেলোয়াড় নেই কেন? সাকিব, তামিম, মুশফিকেরা অবসর নিলে জাতীয় দলে কারা হাল ধরবেন?

খেলোয়াড় আসবে কোত্থেকে? কোনো পরিকল্পনা নেই, আছে গুণ্ডামি, আছে দুর্নীতি! খেলোয়াড়দের মনোবল ভেঙে ফেলা হয় প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগে! ক্যাসিনোর চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর খেলার ফল আগে থেকে নির্ধারণ করা, আম্পায়ারদের দিয়ে অকারণ এলবিডব্লিউ কিংবা কটবিহাইন্ডের সিদ্ধান্ত আদায় করা; কিংবা আউট হওয়া খেলোয়াড়কে নটআউট ঘোষণা দেওয়ানো। কারণ, তা একটা খেলোয়াড়ের জীবন ধ্বংস করে, খেলার মূল স্পিরিট ধ্বংস করে এবং দর্শকদের প্রতারিত করে।

বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট কই? আগে যে একটা নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট হতো, সেই ধরনের আয়োজন তো দরকার হবে নতুন ক্রিকেটার তৈরিতে।
আর আমরা তো শুধু ক্রিকেট নিয়ে থাকতে পারব না। অন্য খেলা ও ফেডারেশনগুলোর খবর কী?

দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা অভিযান শুরু হয়েছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে সরকারি লোকজনকেও ছাড়া হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা তো কেবল ক্যাসিনো নিয়ে নয়। সর্বত্রই সমস্যা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইটা হতে হবে সর্বাত্মক এবং সবগুলো ক্ষেত্রেই। এটাকে একটা জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করতে পারলে সুফল মিলবে। তাহলে সত্যিকারের সোনার বাংলা হয়তো একদিন আমরা দেখে যেতে পারব।

প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যদের কথার সূত্র ধরে ক্রিকেটের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কি ‘অভিযান’ শুরু করা যায় না? তাতে ঝড় বয়ে যাবে, বহু বিষবৃক্ষ উৎপাটিত হবে, কিন্তু সুনীতির সুদিন আনতে গিয়ে ঝড়ের ভয় পেলে তো হবে না। রোগ নির্মূল করতে যদি অস্ত্রোপচার দরকার হয়, কিছু রক্তপাতের জন্য প্রস্তুত তো থাকতেই হবে।

কেঁচো খুঁড়তে গেলে কেউটে সব যদি বেরিয়ে আসে, তাহলে বুঝতে হবে, কেউটে আছে। কেউটের ছোবলে নীল হয়ে আছে আমাদের বহু সেক্টর। কেঁচো খুঁড়তেই হবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক