আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার

যেসব নৃশংস হত্যাকাণ্ড সমাজের বিবেককে মারাত্মকভাবে আঘাত করে, তার রেশ মিলিয়ে যায় না। মানুষ সব সময় প্রতিবাদে সরব থাকতে পারে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তারা ভুলে যায়। ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা কখনো মরে না। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায়ে সরকারের বিভিন্ন মহলসহ তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই সন্তোষ প্রকাশ করেছে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায়ের পর মানুষের স্মৃতিতে নতুন করে আঘাত হেনেছে কতিপয় চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার বিষয়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর–রুনি, নারায়ণগঞ্জের কিশোর তানভীর মুহম্মদ ত্বকী, কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু , সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য।

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ বরেণ্য শিক্ষাবিদ মেধাবী ত্বকীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গভীর উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কেন ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না? বর্তমান সরকারি প্রশাসনে এমনকি কেউ নেই যে, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেবেন? যদি না থাকে, তাহলে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের জন্য সমাজের কাছে স্বীকৃতি আশা করছেন, সেই আশা করা কতটা যুক্তিসংগত ও ন্যায্য? নারায়ণগঞ্জের মাটিতেই সাত খুনের বিচার জাতি দেখেছে। কিন্তু সেখানেই র‍্যাব ঘোষিত অভিযোগপত্রের পরও কিশোর ত্বকীর বিচার–প্রক্রিয়া থমকে রইল। এ রকম অসংগতি বিচ্ছিন্ন নয়। রূঢ় বাস্তবতা হলো, নুসরাত হত্যাকাণ্ডের মতো দ্রুত বিচারের নজির অত্যন্ত কম। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নানা আশ্বাসের পরও মাহমুদা খুনের তদন্ত পর্যন্ত আটকে আছে। অথচ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী এবং যেখানে তাঁর স্বামীই সন্দেহভাজন ঘাতক বলে কথা উঠেছে, পিবিআইয়ের সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি নেওয়ার কথা, অথচ আজ তিন বছর পর দাবি করতে হচ্ছে, এটির তদন্ত যেন পিবিআইকে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে মাহমুদা খুনের মাত্র কয়েক মাস আগেই ধর্ষণের পর খুনের শিকার হয়েছিলেন কলেজছাত্রী তনু। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার ঝোপ থেকে তনুর লাশ পাওয়ার ঘটনায় সারা দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল। তনুর পোশাকে পাওয়া ডিএনএ প্রফাইলের সঙ্গে সন্দেহভাজনদের ডিএনএ মেলানো নিয়ে সৃষ্ট রহস্যজনক জটিলতায় আটকে গেছে তনু হত্যা মামলা। নুসরাত হত্যার রায়ের পর তনুর মা–বাবা অভিন্ন রায় দাবি করেছেন।

সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্দিষ্ট করা ‘জনগুরুত্বসম্পন্ন’ মামলা অনধিক ১২০ দিনের মধ্যে বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতা এটাই নির্দেশ করছে যে, গোটা দেশের মানুষের কাছে এ রকম কোনো বার্তা যায়নি যে, এই রাষ্ট্রে যত বেশি নৃশংস খুনখারাবি ঘটে, সেসবের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের বিচার নিরপেক্ষভাবে এই ট্রাইব্যুনালে হয়ে থাকে। বরং প্রতিটি সরকারই এই ধারণা নিশ্চিত করেছে যে, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক বিবেচনাই এর চালিকাশক্তি। একসময় ফৌজদারি মামলার প্রসিকিউশন হিসেবে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এক দশক আগে এটা রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া পিপি ও এপিপিদের হাতে চলে যাওয়ার পর ফৌজদারি মামলার বিচারে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে, এমন খবর আমরা পাই না। বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুই মাস আগে অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও এখনো অভিযোগ গঠনের জন্য মামলাটি আদালতে যায়নি। এর দায় দলীয়করণের শিকার প্রসিকিউশনের ওপর বর্তায় বলেই প্রতীয়মান হয়।

নুসরাত হত্যাকাণ্ড বা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মতো বিচার দ্রুত সম্পন্ন হওয়ার নজির অবশ্যই ভালো। কিন্তু সরকারকে মনে রাখতে হবে, এর বিপদ হলো, সাধারণ মানুষের কাছে প্রতীয়মান হতে পারে যে, সরকার না চাইলে বুঝি দ্রুত বিচার সম্ভব হয় না।