মেট্রোরেল ও একটি বৃদ্ধ সেতুর গল্প

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের দাবি কোনো মহল থেকে কখনো উঠেছে বলে মনে পড়ে না, কিন্তু সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বন্দরনগরে মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’, তা নিয়ে নগরবাসীর অখুশি হওয়ার কিছু নেই; কিন্তু প্রশ্ন ওঠে অগ্রাধিকার নির্ণয়ের যুক্তি নিয়ে। ৯০ বছরের পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ কালুরঘাট সেতুর জায়গায় নতুন একটি সেতু নির্মাণের বিষয়টি এবারের একনেকে সভায় উঠবে বলে যাঁরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, তাঁরা নিরাশ হয়েছেন। বছরের পর বছর যাঁরা এই দাবি নিয়ে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, অনশন, অবস্থান ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন, তাঁরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।

এবারের একনেক সভায় কালুরঘাট সেতু নির্মাণের বিষয়টি উঠবে—এ নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ একরকম নিশ্চিত ছিলেন। কেননা স্থানীয় সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদল কয়েক দিন আগে এক সমাবেশে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন। একই কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও সাংসদ মোশাররফ হোসেনও। প্রধানমন্ত্রী একনেক বৈঠকে এই সেতুর নকশা নিয়ে তাঁকে হাজির থাকতে বলেছেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি।

এত কথার পরও আবার ঝুলে গেল কালুরঘাট সেতু। কেন একনেক সভায় এই সেতু নির্মাণের বিষয়টি উঠল না, এ নিয়ে চট্টগ্রামের দুই প্রবীণ নেতাও এখন আর মুখ খুলছেন না।

একনেকে যেদিন চট্টগ্রামের মেট্রোরেল চালুর প্রসঙ্গটি উঠল, ঘটনাচক্রে তার পরদিন (১৬ অক্টোবর) কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম অংশ বোয়ালখালী থেকে ফেরার পথে এক দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়েছিলাম। এই অক্টোবরের দুপুরেও তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। বড়-ছোট বিভিন্ন যানবাহনের জানালায় যাত্রীদের বিরক্ত ভ্রুকুঞ্চিত চেহারার দিকে তাকিয়ে কথা বলার ভরসা পাচ্ছিলাম না। দ্বিধা কাটিয়ে আলাপ করলাম চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের ওয়ালিউল ইসলামের সঙ্গে। নগরের টেরিবাজারে ব্যবসা করেন তিনি। চট্টগ্রামে মেট্রোরেল চালু হতে যাচ্ছে এ কথা জানেন কি না, জিজ্ঞেস করতেই মুখ বিকৃত করে বিদ্রূপের সুরে বললেন, ‘গঅত নাই ত্যানা, মিডা দি ভাত হানা...’ (গায়ে নেই কাপড়, তায় আবার গুড় দিয়ে ভাত খাওয়া)। মেট্রোরেলের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের আগে কালুরঘাট সেতুর মতো আশু প্রয়োজন মেটানোর প্রকল্প বাস্তবায়ন দরকার বলে মত দিলেন ওয়ালিউল ইসলাম।

একমুখী সেতুটির একদিকে আটকে থাকা যানবাহন সচল হতে আরও বেশ কিছুটা সময় লাগবে বুঝতে পেরে বড়-ছোট গাড়ি থেকে নেমে যাত্রীদের অনেকেই চা-পান-সিগারেটের দোকানে ভিড় করছিলেন। সেখানে টুটুল নামের এক কলেজছাত্র বেশ দার্শনিকের গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, ‘কালুরঘাটে নতুন সেতু একদিন ঠিকই হবে, কিন্তু তার আগে কয়েক শ লোকের প্রাণহানি ঘটবে। বড় ধরনের একটা দুর্ঘটনা ঘটলে তবেই সরকারের তোড়জোড় শুরু হবে।’

দোকানপাটের সামনে জটলা করতে থাকা লোকজন এখানকার সাংসদ থেকে শুরু করে সরকারি দলের স্থানীয় বড়-ছোট-মাঝারি নেতাদের মুণ্ডপাত করছিলেন। বুঝলাম এই নিষ্ফল ক্ষোভ প্রকাশ এখানকার প্রতিদিনের ঘটনা। এসব শুনতে শুনতে মইন উদ্দীন খান বাদলের সঙ্গে কিছুদিন আগেকার এক ঘরোয়া আলাপচারিতার কথা মনে পড়ল। কয়েকজন সাংবাদিককে দুপুরে ‘ডাল-ভাত’ খেতে ডেকেছিলেন তিনি। সেই আসরে জাসদের এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক সখেদে বলেছিলেন, প্রতিদিন কালুরঘাট সেতুর দুই প্রান্তে ভোগান্তিতে পড়া অন্তত ৫০ হাজার মানুষ তাঁকে মা তুলে গালিগালাজ করেন। এই বয়সে এসব শোনার চেয়ে বরং নিজের দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া ভালো বলে উল্লেখ করে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বরে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের ব্যাপারে ঘোষণা না এলে তিনি পদত্যাগ করবেন। জানি না, সাংসদ তাঁর সিদ্ধান্তে এখনো অটল আছেন কি না, তবে সাম্প্রতিক একনেক সভাটি তাঁর ‘পদত্যাগ’–এর পথ সুগম করেছে বলেই মনে হয়। বোয়ালখালী ও পটিয়ার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ২০ লাখ মানুষের সঙ্গে শহর চট্টগ্রামের যোগাযোগের মাধ্যম এই সেতু। কর্ণফুলী নদীর ওপর ১৯৩০ সালে এই সেতু নির্মাণ করেছিল ব্রিটিশরা। ৪৬ বছর আগে এর মেয়াদ পেরিয়ে গেছে। ২০০১ সালে এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তারপরও জোড়াতালি দিয়ে চালু রাখা হয়েছে কালুরঘাট সেতু। প্রতিদিন শত শত যানবাহনের পাশাপাশি দুই জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন ও একটি তেলবাহী (দোহাজারী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য) ট্রেন যাতায়াত করে এই সেতুর ওপর দিয়ে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুর ওপরের কার্পেটিং উঠে গেছে অনেক স্থানে। অন্তত ৭০টি গর্তের সৃষ্টি হয়েছে সেতুর বিভিন্ন অংশে। কয়েকটি লোহার পাত ভেঙে গেছে এবং সেতুর দুই পাশে লোহার রেলিংয়ে মরচে পড়েছে। প্রয়োজন কোনো নিয়ম মানে না বলেই হয়তো মানুষ এখনো ঝুঁকি নিয়ে এই সেতুর ওপর দিয়ে পারাপার হয়।

কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম দিক শহরের অংশ থেকে বোয়ালখালী সদর গোমদণ্ডীর দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার, অথচ একমুখী এই সেতু পারাপারে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। ১০ টনের বেশি মালবোঝাই গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রায়ই অতিরিক্ত মালবোঝাই ট্রাক যাতায়াত করছে এ পথে। কিছুদিন পরপরই সেতুর ওপর এ ধরনের ট্রাক বিকল হওয়ার ঘটনাও ঘটে। তখন সাধারণ যাত্রীদের দুরবস্থা চরমে পৌঁছায়। বিকল
ট্রাক সরিয়ে নেওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে দুই পাশে আটকা পড়া শত শত যানবাহনে হাজার হাজার যাত্রীর নিজেদের ভাগ্য ও নিয়তিকে দোষারোপ করা ছাড়া পথ থাকে না।

২০১৭ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর ‘রেল কাম সড়ক সেতু’ নামের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছিল। এতে নতুন সেতু নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪৬ কোটি টাকা দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিসিএফ) ঋণ সহায়তা হিসেবে দেবে, এমন চুক্তিও হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে বারবার এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়েছে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের উদ্যোগ।

বোয়ালখালীতে অন্তত ৫০টি কলকারখানা আছে, কিন্তু এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য কালুরঘাট সেতু হয়ে শহরে পৌঁছাতে পারে না। শাহ আমানত সেতু হয়ে ঘুরপথে সেই পণ্য আসে বলে খরচ বাড়ে, সেই বর্ধিত মূল্য গিয়ে পড়ে সাধারণ ক্রেতার কাঁধে। নতুন সেতু তৈরি হলে নতুন কলকারখানা স্থাপনসহ শহরের নিকটবর্তী এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য যেমন সৃষ্টি হবে, তেমনি রয়েছে পর্যটনশিল্প বিকাশেরও এক বিরাট সম্ভাবনা। পাহাড়-নদী-হ্রদ ও অরণ্যের এক অপূর্ব মিলনক্ষেত্র বোয়ালখালী। হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের তিনটি বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র আছে এই অঞ্চলে। প্রতিবছর হাজার হাজার পুণ্যার্থীর সমাগমে মুখরিত হয়ে ওঠে এই অঞ্চল।

সব মিলিয়ে একটি জনপদের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে স্বচ্ছন্দ ও সম্ভাবনাময় করে তুলতে পারে যে সেতু, দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের ডামাডোলেও তার প্রতি উপেক্ষা বিস্ময়কর। নগরে মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের খবরটি শুনে তাই ‘গঅত নাই ত্যানা...’ আঞ্চলিক প্রবাদবাক্যটিকে আরও একবার নিষ্ঠুর সত্য বলে মনে হয়।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]