প্রশাসন: দক্ষতা যোগ্যতার বিকল্প সংখ্যাবৃদ্ধি নয়

আমরা যাঁরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ, জমিদার নই, জোতদার নই, শিল্প-কারখানার মালিক নই, সীমান্ত এলাকায় বিশেষ ধরনের কায়কারবারে যুক্ত নই, তাঁদের ভরসা কিছু জমিজমা এবং চাকরিবাকরি। বিশেষ করে সরকারি চাকরি, যা বলতে গেলে সোনার হরিণ। যাকে ধরতে পারা দুর্লভ সৌভাগ্য। আমাদের পরিবারে এবং নিকট আত্মীয়দের অনেকেই সরকারি চাকুরে। গত দেড় শ বছরে আমাদের পরিবারে কেরানি থেকে সচিব পর্যন্ত ছিলেন। নন-গেজেটেড এবং গেজেটেড বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিবাকরি করেছেন, তাই ছোটবেলা থেকে জানি ইনক্রিমেন্ট কী, প্রমোশন কী?

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কথা মনে পড়ে। ১৫-২০ টাকার একটা ইনক্রিমেন্টের জন্য একজন সরকারি কর্মকর্তার সে কী ব্যাকুলতা। একটি প্রমোশনের সংবাদে একটি পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। ধর্মাবলম্বী অনুযায়ী কেউ বাড়িতে মিলাদের আয়োজন করতেন, কেউ দিতেন মন্দিরে পূজা। কেউ দিতেন জেয়াফত। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কোনো কারণে পদোন্নতি না হলে পরিবারে নেমে আসত শোকের ছায়া।

একজন সরকারি কর্মকর্তার পদোন্নতি যেমন-তেমন প্রাপ্তিযোগ নয়। ৩০-৩৫ বছর আগে কোনো এলাকায় কেউ একজন পদোন্নতি পেয়ে ডেপুটি সেক্রেটারি বা পুলিশ সুপার হলে সমস্ত জেলায় তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ত। একদিন এই দেশেই পদের মর্যাদা ছিল। পদাধিকারীর মর্যাদা ছিল তাঁর ক্ষমতা ও গুরুদায়িত্বের জন্য, অনেক টাকা মাইনে পান সে জন্য নয়।

লোমহর্ষক, রহস্যজনক অথবা কৌতূহল উদ্দীপক সব বড় বড় খবরের মধ্যে গত সপ্তাহে পত্রিকার ভেতরের পাতায় একটি ছোট খবর বেরিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে ১৫৭ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার।...পদোন্নতি দিয়ে কর্মকর্তাদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়েছে। পরে তাঁদের পদায়ন করা হবে। পদোন্নতির পর প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা হয়েছে ৬১০। তবে অতিরিক্ত সচিবের পদের সংখ্যা ১২১টি। ফলে পদ না থাকার পরও পদোন্নতি পাওয়া এসব কর্মকর্তাকে আগের পদেই (ইনসিটু) কাজ করতে হবে অথবা ওএসডি থাকতে হবে। তবে সাধারণত আগের পদেই তাঁদের পদায়ন করা হবে।’ [সমকাল, ২৪ অক্টোবর]

যাঁরা পদোন্নতি পেয়েছেন তাঁদের আন্তরিক অভিনন্দন। তাঁরা উত্তরোত্তর আরও উন্নতি করুন এবং সাফল্যমণ্ডিত হোন, এই কামনা করি। হতভাগ্য জাতি নিশ্চয়ই তাঁদের দ্বারা উপকৃত হবে। তবে সেই সঙ্গে বলব, পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো কালে একসঙ্গে এত বেশিসংখ্যক রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে পদোন্নতি হয়েছে—পাঠকদের কেউ আমাদের জানালে অজ্ঞতা দূর হবে।

পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা আরও বেশি হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি, সম্ভবত শিগগিরই হবে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে: ‘গত বছরের ১৩ নভেম্বর বিলুপ্ত হওয়া ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আগে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকে এবারও বঞ্চিত হয়েছেন।...পদোন্নতি পাওয়ার পরও অনেককে নিচের পদে কাজ করতে হবে। এর আগে গত ১৬ জুন ১৩৭ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত বছরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৯ আগস্ট ১৬৩ জন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব, ২৪ অক্টোবর ২৭৩ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার।’

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ভোটের আগের মুহূর্তে গণহারে পদোন্নতি দেওয়ার নজির আর আছে কি না আমার জানা নেই। আমাদের এই রিপাবলিক যদি একজন ব্যক্তি হতেন, তা হলে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম কাজটি নৈতিক হয়েছে কি না! রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের অনেক সময় নাগরিকেরা তাঁদের স্বার্থের কারণে ঘুষ দেয়, সরকার স্বয়ং যদি উৎকোচ দাতা হয়, তা তাজ্জবের ব্যাপার। যদিও সরকারি চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই যথাসময়ে প্রমোশন প্রত্যাশিত, কিন্তু পদোন্নতি ফান্ডামেন্টাল রাইট নয়।

বার্মা বা বর্তমান মিয়ানমার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপমহাদেশে প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ সরকার যে কয়জন সেক্রেটারি এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে প্রশাসন চালাত, আজ বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। ব্রিটিশ ভারতে অতিরিক্ত সচিবের পদই ছিল না। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনটি মন্ত্রণালয়ে তিনজন এডিশনাল সেক্রেটারির পদ তৈরি করা হয়। যুগ্ম সচিব ছিলেন কয়েকজন। পাকিস্তান আমলে কেউ যুগ্ম সচিব হয়ে অবসরে গেলে তাঁর জীবন সার্থক হতো।

বাংলাদেশের ১৭টি জেলায় ১৭ জন জেলা কমিশনার দু-একজন ইপিসিএস ছাড়া যাঁদের সবাই হতেন সিএসপি অফিসার, বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে দলীয় রাজনীতির প্রভাবের বাইরে থেকে প্রশাসন চালাতেন। ছাত্রনেতা তো দূরের কথা, সরকারি দলের নেতারা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া পাকিস্তান আমলে মহকুমা প্রশাসক, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের অফিসের ত্রিসীমানায় যেতেন না। তাঁরাও রাজনৈতিক লোকদের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করতেন। কোনো কোনো দিন অফিসের কাজ না থাকলে ডিসি এবং এসপির বাংলোর লনে টেনিস, ভলিবল বা ব্যাডমিন্টন খেলতেন পদস্থ কর্মকর্তারা। প্রশাসনে ছিল ভাবগাম্ভীর্য।

কৌটা বা বোতলজাত সম্পূরক খাবার খেলে বাংলাদেশের শিশুরা যেমন তরতর করে বেড়ে ওঠে, বাংলাদেশের পদস্থ কর্মকর্তারাও সরকারের কল্যাণে তরতর করে উচ্চতর পদে পদোন্নতি পান। চাকরিজীবনের স্বল্পতম সময়ে উচ্চতর পদে পদোন্নতির শুরু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সারা জীবন অধ্যাপনা করে প্রফেসর হতে পারেননি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে প্রগাঢ় পণ্ডিত অনেকে প্রফেসর তো দূরের কথা, রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) পর্যন্ত হতে পারেননি। তা পারেননি তাঁদের দুর্বলতার জন্য নয়, পদ ছিল না বলে। বাংলাদেশ আমলে শিক্ষকরাজনীতির সাফল্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোর বিভিন্ন বিভাগ ভরে গেল প্রফেসরে। কোনোরকমে প্রভাষক হয়ে ঢুকলে প্রফেসর হওয়া শুধু কিছু সময়ের ব্যাপার।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখাদেখি প্রবল বেগে প্রমোশন দেওয়া শুরু হয় প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগে। পদ থাক বা না থাক, উচ্চতর পদে প্রমোশন দিতেই হবে। কারও কিছু প্রাপ্তিযোগ হলে অন্যের গাত্রদাহ হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থভান্ডারের অবস্থাটাও তো ভাবতে হবে। পদোন্নতি দেওয়ার পর শুধু যে তাঁর ডেজিগনেশন বা পদে নিয়োজনের নামটার পরিবর্তন ঘটে ত-ই নয়, তাঁর বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা সবকিছুই বদলে যায়। সেসবের পেছনে যে অর্থটা ব্যয় হয়, তা আকাশ থেকে পড়ে না, জনগণের করের টাকা। চেয়ারটেবিল নাই, কাজকর্ম নাই, ঘুরে বেড়ানো, ওদিকে রাষ্ট্রের অর্থ দরিয়া মে ঢালা হচ্ছে। যে দেশে শিক্ষিত বেকারে সয়লাব, যুবসমাজকে কাজ দেওয়া যাচ্ছে না, সেখানে প্রশাসনের ওপরের স্তরে এক পদের বিপরীতে পাঁচ-ছয়জন কর্মকর্তাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়ার যৌক্তিকতা কী, তা আমাদের মতো নাগরিকদের বোধগম্য নয়।

একটি উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে প্রশাসনের দেশপ্রেমিক ও দক্ষ কর্মকর্তাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কখনো ভালো সরকার আসবে, কখনো মন্দ সরকার। প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি দক্ষ হন, দুর্বল সরকারের ঘাটতি তাঁরা পুষিয়ে দেন। কিন্তু কস্মিনকালেও জনগণের বিকল্প আমলারা নন। প্রতিবারই যে তাঁরা ভোটের সময় সহায়ক হবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। সরকারের জনকল্যাণকর নীতি বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের কর্তব্য: অন্যায্য, অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক আবদার রক্ষা তাঁদের দায়িত্ব নয়।

অযৌক্তিক ও বিচিত্র উপায়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের খুশি করার পলিসি আত্মঘাতী। পানি মিশিয়ে দুধের পরিমাণ বাড়ালে পুষ্টিগুণ থাকে না। পানি মেশানোরও একটা মাত্রা আছে। এক লিটারে পাঁচ-ছয় লিটার পানি মেশালে দুধ বলতে কিছু থাকে না, আমাদের প্রশাসনের দশা তেমনটি হতে চলেছে। সত্যিকারের দক্ষ কর্মকর্তারা এতে বিপন্ন বোধ না করে পারেন না। ব্যক্তির উপকার করতে গিয়ে পদটির মর্যাদাকে নিচে নামানো ক্ষতিকর। দক্ষতাকে গুরুত্ব না দিয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সংখ্যা বাড়ালে প্রশাসন অদক্ষ শুধু নয়, অকার্যকর হয়ে পড়বে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক