সড়ক পরিবহন আইন

অবশেষে ১ নভেম্বর থেকে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর হতে যাচ্ছে। ২৩ অক্টোবর সরকারের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এক প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে এটা জানিয়েছে। এই প্রজ্ঞাপনের জন্য দেশবাসীকে অপেক্ষা করতে হয়েছে এক বছরের বেশি সময়। তবু যেমনটি কথায় বলে, কখনো না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভালো। তবে আইনটি কার্যকর করার তারিখ নির্ধারণ পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর দিকে ফিরে তাকালে সংশয় জাগে, আইনটি সত্যিকার অর্থে কার্যকর হতে পারবে তো?

সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ সড়ক পরিবহনে বিশৃঙ্খলা, দায়িত্বহীনতা ও অপরাধ প্রতিরোধের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নে বাধাদানের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের শুরুতে দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি যুগোপযোগী সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ শুরু করে। একের পর এক আইনের খসড়া তৈরি করা হয়, কিন্তু সড়ক পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর প্রবল বাধার মুখে আইনটি চূড়ান্ত করার উদ্যোগ বারবার স্থগিত হয়ে যায়। এইভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে তারা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরও মালিক-শ্রমিকদের বাধা অব্যাহত থাকে। উল্টো দিকে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে একটি আইনের দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। অবশেষে ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ সড়ক পরিবহন আইনের একটি খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদে এবং খসড়াটি সংশোধন করার দাবিতে জেলায় জেলায় ধর্মঘট করে। তাদের প্রবল বাধার মুখে আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়া পর্যন্তই আটকে থাকে।

তারপর ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকায় এক বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ আন্দোলনে ফুঁসে উঠলে সে আন্দোলন প্রশমিত করার জন্য ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস করা হয়। শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের পক্ষে পুরো দেশের প্রবল সমর্থনে আইনটি সংসদে পাস হয় বটে, কিন্তু পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর বিপরীতমুখী চাপও প্রবল হয়ে ওঠে। তারা নতুন আইনটি সংশোধনের দাবিতে ২৮ অক্টোবর সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টা পরিবহন ধর্মঘট পালন করে। তাদের চাপে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আইন কার্যকর করার উদ্যোগ ব্যাহত হতে থাকে। বিষয়টি একপর্যায়ে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে আদালতে রিট মামলা করা পর্যন্ত গড়ায়।

অর্থাৎ সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ কার্যকর করার তারিখ নির্ধারণ পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথটি ছিল অত্যন্ত বন্ধুর। আনুষ্ঠানিকভাবে এটি কার্যকর হওয়ার পরেও যে এর বিরোধিতার অবসান ঘটবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকদের আপাতত এই বলে শান্ত রেখেছে যে আগে আইনটি কার্যকর হোক, সংশোধনের কথা তারপর ভাবা যাবে। বলা বাহুল্য, মালিক-শ্রমিকেরা আইনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা লঘু করার দাবি ত্যাগ করেননি। তাঁদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে: আইনটির সব ধারাকে জামিনযোগ্য করতে হবে; সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের অর্থদণ্ড ২৫ লাখ টাকার জায়গায় করতে হবে ৫ লাখ টাকা; ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি থেকে কমিয়ে পঞ্চম শ্রেণি করতে হবে ইত্যাদি। 

যে আইন পাস ও কার্যকর করতেই এত বাধা, সেটার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করাও অত্যন্ত দুরূহ হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ, এ আইনের বিরোধীপক্ষ সংঘবদ্ধ ও প্রভাবশালী, কিন্তু সব ধরনের অন্যায্য প্রভাব অগ্রাহ্য করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাই তো রাষ্ট্রের কর্তব্য।