বিচারপতি নিয়োগ বাছাইপ্রক্রিয়ার লিখিত রূপ কি আছে?

দীর্ঘদিন পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে একটি বিতর্ক করেছেন। দুজনেই আইন অঙ্গনে জনপ্রিয় নেতা। সভাপতি আওয়ামী লীগের। সম্পাদক বিএনপির। সমিতির কার্যক্রম তাতে খুব বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে শুনিনি। তবে ঘাটতিটা হলো এই,
সমিতি তার ঐতিহ্যগত প্রতিবাদী চরিত্র প্রায় পুরোপুরি হারিয়েছে। গণতন্ত্র বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে অবস্থান নেওয়া তো দূরের কথা, নিজেদের পেশাগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, যার সঙ্গে আবার বিচারপতি নিয়োগের মতো বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা নিয়ে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায়ও নেই। 

গত সপ্তাহে ৯ বিচারপতির নতুন নিয়োগ হলো এবং তার ঠিক আগেই সভাপতি ও সম্পাদক পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন। ১০ বিচারকের সেই বিখ্যাত রায়, যেখানে বিচারক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কী কী করণীয়, তা বলে দেওয়া আছে; তা এই নিয়োগের ক্ষেত্রেও মানা হলো না। এমন একটি রায় পাওয়ার জন্য আমরা উদ্‌গ্রীব ছিলাম এবং তা পাওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম পরিবর্তন আসবে। সেই রায়ের পর বহু বছর কেটে গেছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে নীরবে এবং গোপন বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসছে না। ফলে আমরা এ–সংক্রান্ত একটি আইনের দাবি করে আসছি। কিন্তু নতুন আইন চাওয়ার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাস্তবায়ন বা আদালতের তৈরি করা আইনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার বিষয়টিও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সংসদই শুধু আইন তৈরি করে না। সর্বোচ্চ আদালতও করেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বাছাই ও নিয়োগে টানাপোড়েন সত্ত্বেও আদালতের প্রণীত আইনই কার্যকর রয়েছে। 

বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ১০ বিচারপতির রায়ের আগে ও পরের মধ্যে কোনো ফারাক না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক। আদালতের তৈরি করা আইনটিকে কেউ বলছেন গাইডলাইন বা নীতিমালা। অনেকে আবার নীতিমালা চাইছিলেন। তখন রায়দানকারী অবসরে যাওয়া মাননীয় বিচারপতিরা বললেন, আইন থাকতে নীতিমালা কেন। আইন মানে সুপ্রিম কোর্টের আইন। যার মূলমন্ত্র হলো: কোনো একটি পর্বে বিচারক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় প্রার্থীর পূর্ব বৃত্তান্ত বা গোয়েন্দা তথ্য দেবে সরকার। আইনি প্রজ্ঞা বা অভিজ্ঞতা দেখবেন প্রধান বিচারপতি। রায় বাছাইয়ের বিচারক বাছাইয়ের প্রক্রিয়া হবে স্বচ্ছ এবং এর প্রতিটি ধাপ হতে হবে লিখিত। এই একটি শর্তই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন আমরা খোঁজখবর নিয়েও জানতে পারি না যে বিচারক নিয়োগের এই ধাপগুলো লেখা হচ্ছে কি না। ২০১০ সালের ওই রায়ের পর এ পর্যন্ত বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে ৮০ জন। সুতরাং রায় অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে বিচারক নিয়োগ-সংক্রান্ত একটা বিশাল নথিভান্ডার গড়ে ওঠার কথা। এই সময়ে সাতজন প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে এসেছেন।  আমরা অন্তত এটা জানতে চাই যে এই তথ্যব্যাংক গড়ে উঠেছে। বাছাই শব্দটি যেহেতু রায়ে আছে, তাই কতজনের মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করা হলো—এই প্রশ্নটি বৈধ। 

বৈধতা সব সময় লিখিত আইন থেকে আসে না। আসে স্বচ্ছতার নীতি থেকেও। যদি কেউ আমাদের বলেন, বাছাই তো হয়েছে, কিন্তু সেই তথ্য জনগণের জানার অধিকার নেই। তা হলে সেখানে বৈধতার সংকট রয়েছে। এই বৈধতার সংকট বিএনপি আমলের শেষ দিকে ‘দলীয়’ ও তদবিরের নিয়োগের বিতর্কিত পর্বটিতে হয়েছিল, সে কারণে এখনো তা চলতে পারে না। বিএনপি অস্বচ্ছতার সঙ্গে, তুলনামূলকভাবে কিছু যথেষ্ট অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়েছে বলেই তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। 

আওয়ামী লীগের একটি কমিটির আইনজীবী নেতা ফেসবুকে একটি প্রতিক্রিয়া লিখেছেন। আরেকজন আইনজীবী নেতা সেই ফেসবুক প্রতিক্রিয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। ফেসবুক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘তদবির’ ও ‘মহাতদবির’ এর কথা বলেছেন। বলেছেন নেতাদের কাছে দিনের পর দিন ‘ধরনা’ দেওয়ার কথা। এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত থাকা স্বাভাবিক। এটা পক্ষপাতদুষ্ট এবং অসমীচীন হতেই পারে। কিন্তু আমরা এর বরাত দিলাম, বাস্তবে কী ধারণা বজায় রয়েছে, তা বোঝাতে। খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ হলেও এটা একটা ধারণা। এই রকম নানা ধারণা আছে। স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকার কারণেই এমনটি হচ্ছে। ৯ জনের সবাই যদি যোগ্যতর হন, তাহলে ধরে নিতে হবে সমযোগ্যতাসম্পন্নদের একটি শর্ট লিস্ট ছিল। সেখান থেকে মেধা ও অন্যান্য গুণবাচক শ্রেষ্ঠতার নিরিখে যাঁরা শ্রেয়তর, তাঁরাই নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু এই রকম একটি পারসেপশন সুপ্রিম কোর্ট বা জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে আছে, তা কি আমরা বলতে পারছি? 

আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুরক্ষা চাই। কিন্তু সেখানে যতটা বিচার বিভাগের দায়, সেটা তো তাকেই মেটাতে হবে। স্বচ্ছতার প্রশ্নে সরকারের যা করণীয়, সেটা অনুসরণ না করার জন্য আমরা তাদের সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু বাছাইপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার কোনো ঘাটতির জন্য তাদের সমালোচনা করতে পারি না। ‘সংবিধান অনুসারেই’ সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেছিলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে সংবিধানে স্পষ্ট বিধান রয়েছে। সেই অনুসারেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ হবে।’ ১৭ অক্টোবর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছেন, তার সঙ্গে আমরা দ্বিমত করি না। কিন্তু সংবিধান অনুসারে বলতে বুঝি, স্বচ্ছতার শর্ত যা আদালত আরোপ করেছেন। সুতরাং যে ৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হলো, তাঁদের ক্ষেত্রে যদি বাছাইয়ের কোনো লিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা না হয়, তাহলে স্বচ্ছতার শর্ত পালন হয়নি বলেই ধরে নিতে হবে। 

কেউ আমাদের বলছেন না যে ২০১০ সালের পর থেকেই বিচারক বাছাইপ্রক্রিয়ার একটি লিখিত রেকর্ড সুপ্রিম কোর্টে রক্ষিত আছে। আমরা এই ঘোষণা শুনতে চাই। হতে পারে আদালত প্রশাসন এ-সংক্রান্ত নথিপত্র জনগণের কাছে এখনই উন্মুক্ত করলেন না। কিন্তু সংবিধান বলছে, সুপ্রিম কোর্ট হবে কোর্ট অব রেকর্ডস। এর অর্থ এমন সংকীর্ণ নয় যে এর অর্থ হলো পুরোনো মামলার নথি থরে থরে সাজিয়ে রাখা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নের সঙ্গে বিচার বিভাগের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আর সেই অস্তিত্বের প্রাণভোমরা লুকোনো থাকে বিচারক বাছাই ও নিয়োগে। এই নীতি সর্বজনীন, সভ্যতার মতোই প্রাচীন। 

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]