প্রিক্যারিয়েত: সবচেয়ে 'বিপজ্জনক' শ্রেণি

বিশ্বের দেশে দেশে গণবিক্ষোভের এ সময়ই চিলিতে জমায়েত হয় ১০ লাখ মানুষ। তারা চাইছিল প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বের দেশে দেশে গণবিক্ষোভের এ সময়ই চিলিতে জমায়েত হয় ১০ লাখ মানুষ। তারা চাইছিল প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার। ছবি: রয়টার্স

‘চোরাবাজারে দিনের পর দিন ঘুরি।

সকালে কলতলায়
ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে,
খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্দ শুনি;
মাঝে মাঝে ক্লান্ত ভাবে কী যেন ভাবি—
হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি;
...মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো
হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন।
কলতলায় ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক-সভ্যতার শূন্য মরুভূমি।’ (একটি বেকার প্রেমিক/সমর সেন)

কবিতার বণিক সভ্যতার শূন্য মরুভূমি ঘিরে ধরছে যেন চারপাশ। অসহ্য অসন্তোষ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাখো কোটি আধুনিক বেদুইন—যাযাবর। কাজের সন্ধানে তারা সীমান্ত, সাগর, পর্বত পেরোচ্ছে। আবাদের ছেলেমেয়েদের শহরে এনে ফেলছে জীবিকার চুম্বক। টাকার টানে বদলে যাচ্ছে মন আর চলনবলন। কিন্তু সেই চুম্বক যত টানে, তত কাছে নেয় না। মেটায় না চাহিদা, পুরায় না স্বপ্ন। স্বদেশে পরবাসী আর পরবাসে ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে পড়া এই তরুণদের স্বপ্ন দেখিয়ে পরিত্যাগ করেছে অর্থনীতি—যার মূল নাম পুঁজিবাদ। তাদের হয়েই যেন কথা বলছে লেবাননি তরুণ হুসেইন:

‘আমার দিন চলে না। প্রেম করার সামর্থ্য নেই, বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, নিজের দেখভাল করারও উপায় নেই। তাই আমরা প্রতিবাদ করছি। যাঁরা আমাদের খাবার দিতে পারেন না, তাঁদের আনুগত্য কেন করব?’

‘সুস্বাদু খাবার যেন বিলাসিতা। রাজনীতিবিদেরা কেবল চুরিই করছেন না, চুরি করছেন নির্লজ্জভাবে। আক্ষরিকভাবেই তাঁরা জনগণের জীবনে ক্যানসারের মতো। তাঁরা হিসাবের চেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকছেন এবং তাঁরা বিদায় হলেও তাঁদের সন্তানদের মোকাবিলা করতে হয় আমাদের।’

অথচ লেবাননেরই ১৭ বছর বয়সী শেরবেল অ্যান্টনের কথাটা যেন আধা-উন্নত সব দেশের তরুণের, ‘ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য আমরা দেশেই থাকতে চাই। কিন্তু এসব দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ যদি এখানে থাকে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ শেষ।’

আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা অক্সফাম এ বছরই জানিয়েছে, বিশ্বের ২৬ ধনীর যা সম্পদ, তা দরিদ্রদের অর্ধেকেরও বেশি। ১ শতাংশের হাতে সব সম্পদ কুক্ষিগত। নব্বই দশকের মুক্তবাজার আর বিশ্বায়নের গালগল্প ফাটা বেলুনের মতো পড়ে আছে। পুঁজিবাদের বিকল্প নেই—There is no alternative বা TINA কথাটার জয় দেখানো হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বলয়ের পতনের পর। কিন্তু মানুষ পুঁজিবাদের মধ্যে সব আশার সমাধি হতে দেখে দেখে মরিয়া হয়ে যাচ্ছে। নয়া উদারতাবাদ তথা নিও লিবারেলিজম একদিকে অর্থনৈতিকভাবে মানুষকে শুষছে, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী শাসকেরা চেপে বসেছে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর। কোনো দিকে দম ফেলার উপায় নেই যখন, তখন বৈশ্বিক প্রতিবাদের ঢেউ আজ ইউক্রেন তো কাল ভেনেজুয়েলা, পরশু লিবিয়া তো তার পরের সপ্তাহে ইরাকে মাথা তুলছে। তথ্য বলছে, ১৯৬০-এর দশকের চেয়ে বেশি প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখেছে ২০১৯ সাল।

আলজেরিয়ার যুবকেরা ফেটে পড়েছিল এ বছরই। ২০ বছর ধরে দেশ শাসন করেও সাধ মেটেনি, প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা আবারও নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন মানে আবারও কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় বসবেন জেনে বিক্ষোভ শুরু হলে তিনি পদত্যাগ করেন। চিলিতে বাসভাড়া বাড়ানো, লেবাননে ইন্টারনেট কলের ওপর করারোপ, হাইতিতে দুর্নীতির খবর ফাঁস, হংকংয়ে চীনের কালাকানুনের প্রতিবাদে গণ-অভ্যুত্থান চলমান। ১০ লাখ লোক চিলির প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চাইছে।

দেশে দেশে বিক্ষোভের কারণে ভিন্নতা থাকলেও মোটাদাগে দুটি জিনিস স্পষ্ট। শাসকেরা আর আগের কায়দায় শাসন করতে পারছে না এবং শাসিতরাও আগের জারিজুরিতে আস্থা আনছে না। দ্বিতীয়ত, মধ্যবিত্ত ও তার তলার শ্রেণিগুলোর অর্থনৈতিক দুর্দশার বাড়বৃদ্ধি। তবে একটি বিষয়ে মিল সবখানেই। সবখানেই নতুন এক শ্রেণি উঠে দাঁড়াচ্ছে। এদের বলা হচ্ছে প্রিক্যারিয়েত। গত শতকে যেমন প্রলেতারিয়েত তথা শ্রমিকশ্রেণি ছিল পুঁজিবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের সামনের সারিতে; সহস্রাব্দের পর তাদের জায়গা নিয়েছে প্রিক্যারিয়েত তথা শহুরে নিম্নবর্গ।

এরা কারা? এরা সাধারণ যুবজনতা। যখন সমাজে হতাশা, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা, রাজনীতিতে অমানবিকতা, তখন নতুন পাওয়া শিক্ষা ও ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এরা দ্রুতই জমায়েত হওয়া শিখছে। অস্থায়ী চাকরি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাদের মধ্যে যে ক্রোধ তৈরি করে, বৈরী সরকারের বিরুদ্ধে সেটাই তারা উগরে দেয়। এরাই তাহরির থেকে তাকসিম স্কয়ারে ঘটায় গণবিদ্রোহ। কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী একে বলছেন বিপজ্জনক শ্রেণি।

এদের বেশির ভাগই শিক্ষিত। সামাজিক গতিশীলতা তথা মেলামেশা এবং সংগঠন গড়ার দক্ষতা এবং যোগাযোগে পটুতা এদের বৈশিষ্ট্য। এদের মনে রয়েছে আরেকটু ওপরের শ্রেণিতে ওঠা, বুর্জোয়াদের মতো না হোক, মোটামুটি মধ্যবিত্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষা এদের জ্বালায়। এরা দেখে, তাদেরই কোনো প্রতিবেশী বিদেশে কী সুন্দর জীবন কাটাচ্ছে, অথচ তার সামনে সব সুযোগের দরজা বন্ধ। শিক্ষিত করতে গিয়ে পরিবার তাদের পেছনে সব খরচ করে ফেলেছে, অথচ চাকরির বাজারে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ নেই। কাজ থাকলেও দিবারাত্র পরিশ্রমে এদের জীবনীশক্তি নিঃশেষিত। বিপদে-আপদে কাজে লাগার মতো সঞ্চয় বা আত্মীয়ও নেই। তার ওপর তারা দেখছে শাসকেরা যা খুশি তা-ই করে যাচ্ছে তাদের দেশ, সময় ও সম্পদ নিয়ে। অপমান করে যাচ্ছে প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদাবোধকে।

এমন অবস্থায় সামান্য কোনো করারোপ কিংবা মূল্যবৃদ্ধি অথবা বৈষম্যের নতুন ব্যবস্থাপনা অথবা পুলিশের কোনো অত্যাচারে তাদের সবার মনে জমা বারুদে একসঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। তা ঘটলে যা হয়, সেটাই এখন দেখা যাচ্ছে আরব থেকে এশিয়া, আফ্রিকা থেকে লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশে। পরপর বা একসঙ্গে যা ঘটছে, তা এককথায় বৈষম্য ও অন্যায্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ।

বাংলাদেশে এদের দেখতে পান? বর্তমান অনিশ্চিত, ভবিষ্যৎ দুঃস্বপ্ন দেখায়, জীবনে কিছু হওয়ার সুযোগ যায় যায়, কিছু ভাল্লাগে না যাদের—সেসব নোভ্যাট, কোটা সংস্কার, সড়কে জাস্টিসের রাষ্ট্র মেরামতকারীরা আমাদের প্রিক্যারিয়েত। এরা ন্যায্যতা চায় জীবন-জীবিকায়, অধিকার চায় জীবনের ওপর, চায় জনগণকে ক্ষমতায়িত করবে—এমন গণতন্ত্র।

কিন্তু প্রতিবাদের মাধ্যমে ব্যবস্থার ম্যানেজার বদল করা কিংবা একটি-দুটি সংস্কার করা এক কথা, আর সংকটের উৎস আগ্রাসী পুঁজিবাদের জায়গায় উন্নততর মানবিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আরেক কথা। স্বতঃস্ফূর্ত প্রিক্যারিয়েতের বিক্ষোভে সেটা হওয়ার নয়। তার জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপরেখা দরকার, দরকার স্থায়ী ও দূরদর্শী নেতৃত্ব, যারা বিপদের সময়ও হাল ধরে থাকবে, শান্তির সময় চালাবে পুনর্গঠনের কাজ। রাজনীতিবিরোধিতা দিয়ে সেটা কখনো হয়নি, হবেও না। সেটা এক মাসের কাজ না, এক দশক কিংবা তারও বেশি সময়ের কাজ। সেটা এক দেশের জাগরণের মাধ্যমেও হবে না, দেশে দেশে চলমান আন্দোলনগুলোর মধ্যে অভিন্ন লক্ষ্য বিষয়ে সমঝোতার মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থাকে বদলানোর কাজ। আঞ্চলিক রাষ্ট্রের মধ্যে আটকে পড়া দেশীয় রাজনীতি এ সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। হয়তো সরকার বদলাবে, কিন্তু পুঁজিবাদের গভীর গভীর সংকটের জাল তো বিশ্বজুড়েই ছড়ানো। তাকে বদলাতে হলে চাই জলবায়ু রাজনীতির মতো নতুন বৈশ্বিক রাজনীতি, যেখানে মুক্তিকামী দেশের জনগণ তাদের পক্ষের সরকারগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংহতি ও সংগ্রামকে এগিয়ে নেবে।

আজ হয়তো এসব কথা উচ্চাশার মতো শোনাবে। কিন্তু বিদ্যমান পুঁজিবাদের যদি বিকল্প না থাকে, তাহলে বলতে হবে, বিকল্প জীবনেরও কোনো সুযোগ আর নেই। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে এই অর্থনীতি পৃথিবীকেই ধ্বংসের কিনারে নিয়ে এসেছে। আর সমাজ ও মানুষ? তা নেমে যাচ্ছে আগের চেয়েও অমানবিক দশায়, যে দশাকে আর মানুষের জীবন বলা চলে না। জীবন আমাদের নয় বলেই জীবনকে আমাদের করে নেওয়ার এমন উত্তাল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে বৈশ্বিক প্রতিবাদের ঢল।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]