মৃত্যুদণ্ডের রায়: কিছু প্রশ্ন, কিছু অস্বস্তি

নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায় সমাজে প্রশংসিত হয়েছে। এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের জন্য ১৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর মূল হোতা মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার সঙ্গে সঙ্গে দোষী আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা চরম দণ্ড পেয়েছেন। এটি স্পষ্ট যে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই মামলায় কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি।

অপরাধী শক্তিশালী হলে বা ক্ষমতাসীনদের লোক হলে ছাড় পায়—এটি বাংলাদেশে একটি সাধারণ ঘটনা। সাগর-রুনি, তনু, মিতু, ত্বকী এমন বহু ঘটনায় আমরা এমন বার্তা পেয়েছি। দেশে আইনের শাসন থাকলে যা কখনো হওয়ার কথা নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে নুসরাত হত্যার বিচার তাই কিছুটা হলেও স্বস্তি সৃষ্টি করেছে।

এ বিচার অবশ্য কিছু প্রশ্ন ও অস্বস্তিকেও তুলে ধরেছে। বিশেষ করে উচ্চ আদালতে এ শাস্তি টিকবে কি না, তা নিয়ে অনেকের আশঙ্কা রয়েছে। অতীতে কিছু চাঞ্চল্যকর মামলায় বিচারিক আদালতে চরম দণ্ড পাওয়া ব্যক্তিরা উচ্চ আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন বলে এ আশঙ্কা অবান্তর নয়। আশঙ্কা রয়েছে সব বিচার শেষ হওয়ার পর অপরাধীরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে যান কি না, এ নিয়েও।

এ ছাড়া নুসরাত হত্যার বিচারের তাৎপর্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সমাজে। এটি কি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে বা নারীদের প্রতি ভয়াবহ সহিংসতা দমাতে ভূমিকা রাখবে? নাকি একটি বিচ্ছিন্ন বিচার হিসেবে এর রেশ মিলিয়ে যাবে দ্রুত?

কোনো দেশে আইন ও বিচারব্যবস্থায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকলে এসব প্রশ্ন ওঠে না সাধারণত। কিন্তু এ দেশে তা উঠছে, অতীতেও উঠেছে মূলত এসব ব্যবস্থার নানামুখী সংকটের কারণে। সমাজের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তাই এসব সংকটের চিত্র আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

২.
নুসরাতের হত্যাকারীদেরও শাস্তি হয়েছে নিম্ন আদালতে। নিম্ন আদালতে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হয়েছিল। কিন্তু পরে উচ্চ আদালতে এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন পাওয়া অধিকাংশ অপরাধী খালাস পেয়েছিলেন। রাজপথে সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডের পর কিছু অপরাধী দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগও পেয়েছিলেন। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কলেজছাত্রী বুশরা হত্যাকাণ্ডে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট একজনকে ফাঁসির ও আরেকজনকে যাবজ্জীবনের শাস্তি দিয়েছিলেন। পরে দুজনই ছাড়া পান আপিল বিভাগ থেকে। বজ্রাহত বুশরার মা বলেছিলেন, ‘এখন মনে হয় বুশরা নামে কেউ ছিল না, কেউ খুনও হয়নি।’ এ রকম আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে এ দেশে অতীতে।

এসব ঘটনা খুব স্বাভাবিক নয়। উচ্চ আদালতে বাদীপক্ষের হয়ে মূল আইনি যুদ্ধ করে থাকে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস। সেখানে দুর্বলতা বা পক্ষপাতিত্ব থাকলে বা নিম্ন আদালতের রায়ে ত্রুটি থাকলে, এমনকি মামলার ভিত্তি যে পুলিশি তদন্ত, সেখানে ফাঁকফোকর থাকলে কেবল এসব ঘটনা ঘটতে পারে। উচ্চ আদালতে কোনো সমস্যা থাকলেও এমন হতে পারে।

নুসরাতের খুনিরা শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত এসব অস্বস্তি থাকবে। তবে এ মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত প্রত্যেকেই যে সমভাবে অপরাধী, তা আমরা এখনই বলতে পারি না। কারণ, আলোড়ন সৃষ্টিকারী হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালত কর্তৃক গণহারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে এ দেশে।

৩.
একটি হত্যায় আসামিরা সবাই বা অনেকে চরম শাস্তি পান কেবল এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে তাঁদের প্রত্যেকের কমন ইনটেনশন (সেকশন ৩৪, পেনাল কোড) বা তাঁদের বেআইনি সমাবেশটির কোনো কমন অবজেকটিভ (সেকশন ১৪৯, পেনাল কোড) থাকলে। উচ্চ আদালত কারও কারও ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু সম্পর্কে সন্দিহান থাকলে তাঁকে চরম দণ্ড থেকে রেহাই দিতে পারেন। তবে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় কতটুকু এ কারণে আর কতটুকু পুলিশি রিপোর্ট আর সরকারি কৌঁসুলিদের ব্যর্থতা বা অনাগ্রহে এমন ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।

বিচারিক আদালতের বিচারে মারাত্মক ব্যত্যয় থাকলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে এমনকি পুনরায় বিচারের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা আছে আপিল আদালতের (সেকশন ৪২৩, ফৌজদারি কার্যবিধি)। আবার বিচারে আসামিরা খালাস পেলে অপরাধ তাহলে কে করেছেন, তা আরও তদন্ত করে দেখতে পারে পুলিশ। কোনো কোনো ঘটনায় এর কোনোটিই (যেমন বুশরা হত্যাকাণ্ডের বিচারে) করা হয়নি।

নুসরাত হত্যাকাণ্ডের বিচারে হয়তো এসব কিছুই হবে না। হয়তো শেষ পর্যন্ত এতে ন্যায়বিচারই হবে, কেউ সত্যি নির্দোষ থাকলে ছাড়া পাবেন, দোষীরা উপযুক্ত সাজা পাবেন। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টি নিয়ে।

৪.
অতীতে হিংস্র খুনি থেকে কুখ্যাত মাস্তানদের পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাওয়ার নজির রয়েছে। অথচ দেশে দেশে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক এই ক্ষমা করার বিধান রয়েছে শুধু চরম মানবিক বিষয় বিবেচনার জন্য। যেমন স্কটল্যান্ডের লকারবিতে বিমান উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত লিবিয়ার অপরাধী আবদেল মেগরাহিকে ২০০৯ সালে ক্ষমা করা হয়েছিল ক্যানসারের কারণে, তাঁর অবধারিত মৃত্যুর আগের শেষ দিনগুলো স্বজনের সঙ্গে কাটাতে দেওয়ার মানবিক দিক বিবেচনা করে।

এ দেশে এটি করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে। ক্ষমা করার এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হলেও সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুসারে তিনি এটি করেন আসলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এ পরামর্শ দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাইয়ের পর। দুটো মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দপ্তরের মাধ্যমে এ ক্ষমতা অতীতে লক্ষ্মীপুরের বিপ্লবের মতো ভয়াবহ ও নৃশংস খুনিরা পেয়েছেন।

ফলে সমাজে এই অস্বস্তি থাকা স্বাভাবিক যে এমন ক্ষমা পেতে পারেন যেকোনো অপরাধী।

৫.
নুসরাতের পরিবার শেষ পর্যন্ত সুবিচার পাবে, এটি আমাদের প্রত্যাশা। তবে সেটি যেন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে সমাজে থেকে না যায়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এমন আলোড়ন সৃষ্টিকারী বহু হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনো শুরুই হয়নি। সাগর-রুনি, তনু, মিতু আর ত্বকী হত্যার বিচার প্রাথমিক ধাপেই ঝুলে আছে অনেক বছর ধরে। এসব মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল, তাঁরা প্রত্যেকে রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী মানুষ। সমাজে এই অস্বস্তি রয়েছে যে তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন এ কারণেই। রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বলে অভিজিৎ ও দীপনের মতো মুক্তমনা মানুষকে হত্যার বিচারও আদৌ হবে কি না, এ নিয়ে প্রবল সন্দেহ আছে তাঁদের স্বজনদের মধ্যেই।

আমাদের সরকার বহুবার দাবি করেছে, এ দেশে পুলিশ যথেষ্ট দক্ষ আর আদালত পুরোপুরি স্বাধীন। কিন্তু রাষ্ট্রের এসব প্রতিষ্ঠানকে নাকচ করে দেওয়ার ক্ষমতা যদি কোনো খুনির থাকে, তাহলে বলতে হবে এ দেশে আইনের শাসন নেই, বরং অনেক ক্ষেত্রে আছে জঘন্য অপরাধীর দাপট।

সমাজে এমন ধারণা ভেঙে স্বস্তির বাতাস আনতে হবে। এ জন্য এক নুসরাত নয়, সব হত্যার বিচার করতে হবে। বিশেষ করে আলোড়ন সৃষ্টিকারী খুনেরই যদি বিচার না হয়, তাহলে আলোড়ন তুলেই সমাজকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে এই সমাজে ন্যায়বিচার নেই।

মনে রাখতে হবে, ন্যায়বিচার আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের সবচেয়ে বড় একটি স্তম্ভ।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক