আমাদের দায়, মেটাচ্ছে গাম্বিয়া

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

জাতিগত শুদ্ধির নামে মিয়ানমার তার দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ আর বাস্তুচ্যুত করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে। এসব অপরাধ আর অনাচারের সব আলামত হাতে পেয়েও আমরা যখন সাত–পাঁচ, চৌদ্দ–সতেরো ভাবছি, তখন পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া (এ দেশের অনেক পত্রপত্রিকায় আর অনলাইন গণমাধ্যমে অবশ্য দেশটির নাম জাম্বিয়া ছাপা হয়েছে) আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় বাদী হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে দেশটির সরকার। তারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী আর গণহত্যার অভিযোগ করবে।

আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে গাম্বিয়ার চেয়ে ছোট দেশ আর নেই। কিন্তু স্বীকার করতে হবে তাদের কলিজা আছে। মাত্র ১০ হাজার ৩৮০ বর্গকিমি আয়তনের প্রায় শুঁয়োপোকার মতো লম্বাটে শরীরের একটা দেশ গাম্বিয়া। যার একদিকে একচিলতে সাগর আর বাকি তিন দিকে বিশাল প্রতিবেশী সেনেগাল। মানচিত্রে দেখলে মনে হবে সেনেগালের পেটের মধ্যে একটা চিকন দেশ ঢুকে আছে। জনসংখ্যা সাতক্ষীরা জেলার মোট জনসংখ্যার চেয়ে কম—কুল্লে ২০ লাখ। কিন্তু তারা প্রমাণ করে দিল গতরে বিপুল হলেই হয় না, সাহস আর নিয়তটাই বড় কথা। দেখিয়ে দিল যদি ডাক শুনে কেউ না আসে তবে কেমন করে এগিয়ে যেতে হয়।

গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবাকার মারি তামবাদু শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে এ কথা আবার স্পষ্ট করে বলেছেন। হেগের ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল স্টাডিজ আয়োজিত এক সেমিনারের প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি গাম্বিয়ার অবস্থান তুলে ধরেন। কনক্লেভ অন জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউনটেবিলিটি শীর্ষক এই আন্তর্জাতিক মতবিনিময়মূলক আলোচনার সহ-আয়োজক ছিল এশিয়া জাস্টিস কোয়ালিশন এবং বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব পিস অ্যান্ড জাস্টিস।

এর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ-ওআইসির পক্ষে এই মামলা লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গাম্বিয়া। ওই দিন নিউইয়র্কের বাংলাদেশের দূতাবাসে কুটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় গাম্বিয়া তাদের এই সিদ্ধান্তের কথা উপস্থিত কূটনীতিকদের জানিয়ে তাঁদের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা তাদের বেশি দরকার।

ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখিত সেমিনারে তামবাদু বলেন, আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে এই মামলা করার জন্য ৪ অক্টোবর আমি আইনজীবীদের নির্দেশনা দিয়েছি।

তামবাদুকে উখিয়ার জরাজীর্ণ শরণার্থী শিবিরে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন, তাঁরা তাঁর চোখের পানিও দেখেছিলেন। বক্তৃতায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথা আবার জানিয়েছেন ‘আমি যখন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যাই, তখন দূর থেকেই গণহত্যার দুর্গন্ধ পেয়েছি আমি। রুয়ান্ডায় চালানো গণধর্ষণ, হত্যা এবং গণহত্যার এক দশক পর রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যার এই দুর্গন্ধ আমার কাছে পরিচিতই মনে হয়েছে।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধ আর গণহত্যার বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ বিচারসভা বিচার শেষে খুব বড় গলায় বলেছিল ‘‘আর কখনোই না’’। আর কখনোই গণহত্যা হবে না, আমাদেরও আর বিচারে বসতে হবে না। বলা বাহুল্য, গণহত্যা বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশ বসনিয়া, কসোভো, রুয়ান্ডা, মিয়ানমার, গাজা, পশ্চিম তীর, সিরিয়া, কুর্দিস্তান, হালআফজা কিছু নাম জানা যায়; কিছু গোপন থাকে, বন্ধ হয় না গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ।

গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রীকে সমর্থন করে মিয়ানমারে নিযুক্ত কানাডার বিশেষ দূত বব রাইও বক্তব্য দেন। তাঁর মতে, রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের জন্য মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক মহলের জবাবদিহি করতেই হবে। গত শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) বিকেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ আবারও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের বিচার দাবি করে বলেছেন, এ সমস্যা সমাধানে যা প্রয়োজন মালয়েশিয়া এবং অন্যান্য আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রগুলো তার সবকিছুই করবে। তিনি খুব পরিষ্কার করেই বলেছেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে এবং এর বিচার হতে হবে।

মালয়েশিয়া অবশ্য শুরু থেকেই গণহত্যার বিচারের কথা বলে এসেছে। সংকটের শুরুতে (সেপ্টেম্বর ২০১৭) কুয়ালালামপুরের পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামের একটি আন্তর্জাতিক গণ-আদালতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি, সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াংসহ অন্য কর্মকর্তারদের বিরুদ্ধে বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করে।

শুনানিতে রোহিঙ্গা ও কাচিন সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বর্ণনা দেন। শুনানিতে অংশ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্ট্যাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের বিভাগের অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটন তাঁর জবানবন্দিতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সর্বস্তরে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার বলে বর্ণনা করে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ,বৌদ্ধ মিলিশিয়া এবং দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকার অভিযুক্ত। রাজধানী কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে অনুষ্ঠিত এই বিচারকাজে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আট সদস্যের বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি এই প্রতীকী বিচারের শুনানিতে বাংলাদেশের সরকারি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে বাংলদেশে সে উদ্যোগের খবর তেমন প্রচার পায়নি।

বিচারটা প্রতীকী হলেও রোম স্ট্যাটিটিউটে (১৯৯৮, কার্যকর ২০০২) এ ধরনের আদালত গঠন করার কথা বলা হয়েছে। ইরাকেও এ ধরনের আদালত গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের গণহত্যার ঘটনা সত্যিকারভাবে আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরতে পারে, তাহলে মিয়ানমারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করা সম্ভব।

মিয়ানমারকে একটা ন্যায্য সমাধানে রাজি করাতে হলে আলোচনা আর তালিকা বিনিময়ের পাশাপাশি অন্য সব চাপও অব্যাহত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করার চাপটাও খুব জরুরি। তবে এটা যেন জুজুতে পরিণত না হয়। সব শরণার্থী ফিরিয়ে নিলেও আমরা যেন মামলা তুলে না নিই। ধর্ষিত শিশুর গরিব পিতার মতো আচরণ না করি। এটা শুধু রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য নয় বরং গণহত্যার আগামী উদ্যোক্তাদেরও এভাবে হুঁশিয়ার করা দরকার।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]