যেখানে বিনিয়োগ বাড়ালে ফেরত আসবে বহুগুণ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আমরা প্রায়ই জনমিতিক লভ্যাংশ বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কথা বলি। এর অর্থ হলো আমাদের জনসংখ্যা যে বেশি, সেটা অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। ব্যাপারটা সহজে চোখে পড়ে না। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম এবং তাদের ৩৫ শতাংশ, মানে অর্ধেকের বেশি তরুণ। এই তরুণদের যদি আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে পারি, তাহলে তাঁরা দেশে ও বিদেশে উপযুক্ত ও উঁচু মর্যাদার চাকরি করে নিজেদের তো বটেই, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারেন।

দক্ষতা উন্নয়নে কাজ কিন্তু কম হচ্ছে না। তবে সেটা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী হচ্ছে কি না, সেখানেই প্রশ্ন। দেশীয় একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্যাকেজিং কাজের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিতে চায়। ইন্টারভিউয়ে ডাকল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় দক্ষতার একজন উপযুক্ত কর্মীও দেশে পেল না। শ্রীলঙ্কার একজনকে নিয়োগ দিতে হলো।

এ ধরনের মনভাঙা কথা সেদিন আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় আসে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দক্ষতার উন্নয়নে বিনিয়োগ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সহযোগিতায় প্রথম আলো এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সেখানে আরেকজন আলোচক বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, হয়তো ঘুরেফিরে কয়েক শ তরুণ দশ-বারো রকম কাজের উচ্চ দক্ষতার ট্রেনিং নিচ্ছেন, তা–ও আবার এমন বিষয়ে ট্রেনিং, যার হয়তো বাজারে তেমন চাহিদা নেই।

তাই আগামী অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দক্ষতা উন্নয়নে অর্থবহ বিনিয়োগের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। তারা বিশেষ নজর দেবে যেন অপরিকল্পিতভাবে দক্ষতা উন্নয়নের কর্মসূচি নেওয়া না হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বিতভাবে পরিচালনার ওপর জোর দেওয়া হবে।

শুধু তা-ই নয়। আমরা উন্নত দক্ষতার ট্রেনিং দিলাম, সার্টিফিকেটও দিলাম, কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বা জাপানে সেই সার্টিফিকেট কোনো দাম পেল না। তাহলে আমাদের দক্ষ কর্মী কিন্তু বিদেশে গিয়ে কম বেতনে চাকরি করতে বাধ্য হবেন।

তাই আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশন দরকার। সেটা কীভাবে হতে পারে, তা কর্তৃপক্ষ জানে। আমরা ট্রেনিং দেব, সার্টিফিকেট দেবে প্রয়োজনে হয়তো জাপানের কোনো ফার্ম। তাহলে চট করে আমাদের কর্মী জাপানে উপযুক্ত পদ, মর্যাদা ও বেতনের চাকরি পাবেন। এই ব্যাপারটায় আমরা এত দিন পিছিয়ে ছিলাম। এখন নজর দেওয়া হচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য, সিনিয়র সচিব শামসুল আলম বললেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, সমাজে অসাম্য কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। এর জন্য দরকার দক্ষতার উন্নয়নে আরও কার্যকর বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এক গুণ বাড়ালে হয়তো দশ গুণ ফেরত আসবে! এর চেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ আর কী হতে পারে।

এখানে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ হবে যদি আমরা নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে বেশি জোর দিই। আমাদের নারীরা অদম্য। হেন কাজ নেই যা তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেন না। ধরুন দক্ষ মিডওয়াইফ গড়ে তোলা। দেশে ও বিদেশে অনেক চাহিদা। ট্রেনিংয়ের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অথচ অগ্রগতি এখনো চোখে পড়ার মতো নয়। শুধু দক্ষ মিডওয়াইফের জন্য জেলায় জেলায় ব্যক্তিমালিকানায় ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠার কথা। আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। তাহলে শুধু এই ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশেই চাকরি হবে হাজারে হাজার। তারপর মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, জাপানে প্রতিবছর হাজার হাজার দক্ষ মিডওয়াইফ মর্যাদার চাকরি নিয়ে যাবেন। রেমিট্যান্স এক বছরে কোথায় চড়ে তখন দেখবেন।

শুধু তা-ই নয়। ড্রাইভিংও একটি মর্যাদার পেশা। নারীরা উঁচু দক্ষতার ট্রেনিং পেলে ভালো চাকরি পাবেন। বিদেশে ভালো বাজার আছে।

বিএ-এমএ পাস করা উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবীদেরও দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, আমরা যে বলি চতুর্থ, এমনকি পঞ্চম শিল্পবিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে, তার জন্য দেশে-বিদেশে প্রচুর কর্মী দরকার। কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস, রোবটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মহাকাশবিজ্ঞান প্রভৃতি অগণিত ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কার প্রযুক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। তাই প্রতিনিয়ত দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা হয়তো নিজেদের ও সরকারের বিশেষ সহযোগিতায় নিজেরাই এগিয়ে যাবেন। তাঁরা পিএইচডি করে গবেষণা করবেন। দেশের জন্য হয়তো খুব শিগগির আমাদের কোনো বিজ্ঞানী নোবেলজয়ী হবেন। দেশেরও সুনাম বাড়বে।

কিন্তু আমাদের তরুণসমাজের যে অংশ আপেক্ষিকভাবে অসচ্ছল, তাদের সামনেও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁরা এসএসসি বা এইচএসসি পাস করে টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল ট্রেনিং নিয়ে ডিগ্রি পাবেন। তারপর আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশেষ দক্ষতা অর্জন করবেন। বাজারের চাহিদা বুঝেই এসব দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে।

আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই দিকে বেশি জোর দিলে দেশ বেশি লাভবান হবে। কারণ, সবাই বিএ-এমএ পড়বেন না। বেশির ভাগ তরুণই কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতায় পারদর্শী হবেন। তাঁদের জন্য আমাদের দরজাটা আরও বেশি করে খুলে দিতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক