প্রশ্নবিদ্ধ আমদানি ও গো-হারা মাংস খাত

ছবি: আবদুস সালাম
ছবি: আবদুস সালাম

‘চিন্ত্যা করো নুরু, দ্যাশ আইজ কুথায়; পাঁঠা—সেও নিজের কাম বাদ দিয়া দৈনিক আধা লিটার কইরে দুধ দিতেছে!’—মহল্লার খলিল মিয়ার চায়ের দোকানে বসে জলিল মোল্লা যখন পাশে বসা লোকটিকে এই কথা বলছিলেন, তখন বিশ্বাস হয়নি। পরে দেখা গেল ঘটনা সত্য। খবরের কাগজে দেখলাম, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার রশিদপুর মোলান বাজারের একটি প্রজনন খামারে ‘পঙ্খীরাজ’ নামের ‘একজন’ পাঁঠা আসলেই দুধ দিচ্ছে। 

পাঁঠার ওলান থেকে ছাগদুগ্ধ নিষ্কাশনসংক্রান্ত এই ‘পরসমাচার’ প্রকাশের পরপরই জানা গেল, দেশে ছাগলের (পাঁঠাসহ) সংখ্যা কমে গেছে। এতে অবশ্য আছাড়ি-পিছাড়ি টাইপের আহাজারি করার কিছু নাই। কারণ ছাগল কমলেও গরুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষিশুমারিতে দেখা গেছে, দেশে এখন ছাগলের সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লাখ ৮৭ হাজার ৪১৩। আর গরু আছে ২ কোটি ৮৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪১৫টি। গত বছরের চেয়ে এ বছর ছাগল কমেছে ৬৬ লাখ। গরু বেড়েছে ৪৬ লাখ। তার মানে অন্যত্র ‘গো মাংস’ শব্দটি যতই স্পর্শকাতর হোক, আমাদের দেশের এই ‘গো সাফল্যে’ খামারিদের মুখে আকর্ণ হাসি ফোটার কথা। কিন্তু সম্প্রতি গরুর মাংস আমদানি নিয়ে ছাপা হওয়া একটি খবর দেখে মনে হচ্ছে, সেই সম্ভাবনার শুভ্র চাদরেও এখন গোবর লেপ্টে যাচ্ছে। 

বছর চারেক আগে কাঁটাতার পার হয়ে গরু আসা বন্ধের খবর ছড়াতেই গরুর মাংসের দামে লাফালাফি শুরু হলো। ছিল সাড়ে চার শ টাকা কেজি। এক লাফে গেল ছয় শতে। কোরবানির সময় গরুর আকাল দেখে খামারিরা ‘গরু খোঁজা’ শুরু করল। দাম বেশি দেখে খামারিরা আটঘাট বেঁধে গরু পালন শুরু করলেন। বছর দুয়েকের মধ্যে দেশি গরুর আকাল কাটতে লাগল। 

সংসদে দাঁড়িয়ে গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ‘দেশ গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ কেবল তা-ই নয়, ‘দেশ গরু-ছাগলের মাংসে উদ্বৃত্ত’—এই তথ্য উল্লেখ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গরু-ছাগলের মাংস রপ্তানির উদ্যোগও নেওয়া হয়। 

দেশ যখন মাংস রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেই সময় খবর বেরিয়েছে, দেশে হিমায়িত গরু ও মহিষের মাংস আমদানি করা হচ্ছে। ভারত, সৌদি আরব ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে গত ছয় মাসে ২০ লাখ ৪৩ হাজার কেজি হাড্ডিবিহীন মাংস আমদানি হয়েছে। এখন ব্রাজিল থেকে আরও বেশি পরিমাণে হিমায়িত গরুর মাংস আমদানির প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে। তার মানে গরু–ছাগলে যখন আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছি, তখনই খামারিদের কোমর ভাঙার সব জোগাড়যন্ত্র করা সারা! 

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রাণিসম্পদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যানিমেল হেলথ কোম্পানি অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে মাংস আমদানি বন্ধ করতে সরকারকে অনুরোধ করেছে। একই দাবি মাংস ব্যবসায়ী সমিতির। কিন্তু তারপরও মাংস আমদানির চিন্তা থেকে সরকার এখনো সরে আসেনি। 

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ গরু-ছাগল এখন উদ্বৃত্ত। আমরা বিদেশে মাংস রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেখানে আমদানির প্রশ্নই আসে না।’ 

এত আপত্তির পরও ব্রাজিল থেকে মাংস আনতে হবে কার স্বার্থে, সেটি মাথায় নেওয়া দরকার। দেখা যাচ্ছে, তৈরি পোশাক রপ্তানির বিনিময়ে হিমায়িত গরুর মাংস আমদানির জন্য বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে ব্রাজিল সরকার। প্রস্তাবটি বিবেচনায় নেওয়া যায় কি না, সে সম্পর্কে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি ধারণাপত্র জমা দিয়েছে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। 

যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, ব্রাজিল থেকে মাংস আমদানি করলে আমরা ব্রাজিলে পোশাক রপ্তানির সুযোগ পাব। এতে পোশাক খাতে আরেকটি বড় বাজার যুক্ত হবে। কিন্তু জামাকাপড়ের বাজার ধরতে গিয়ে ঘরের গরু খামারিদের পেটে লাথি মারা কদ্দুর ইনসাফ হবে, তা বিবেচনার বিষয়। 

সাধারণ চাহিদা ও সরবরাহের সূত্রমতে, মাংস যত বেশি আমদানি হবে আমাদের খামারিরা তত কোণঠাসা হবেন। হোটেল–রেস্তোরাঁয় তাঁরা যে দামে মাংস সরবরাহ করতেন, আমদানিকারকেরা তার চেয়ে অনেক কম দামে ভারত, সৌদি আরব ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা হাড্ডিবিহীন মাংস সরবরাহ করছেন। আমদানি করা মাংসের দামে খামারিদের মাংস দিতে তাঁদের অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে। খামারিরা গরু পালন থেকে সরে যাওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন। এর মধ্যে ব্রাজিল থেকে নতুন করে মাংস আসা শুরু হলে তাঁদের গরুর সঙ্গে গোয়ালও বেচে দিতে হবে। 

 সাধারণত বাংলাদেশের কোনো একটি খাত যখন একটু উঠে দাঁড়াতে থাকে, তখন সেটিকে পিঠমোড়া করে বেঁধে মাটিতে ফেলার জন্য যা যা দরকার, তার সব আয়োজন করা হয়। সেই আয়োজকদের বদ নজর এখন পড়েছে অবলা দেশি গরু-ছাগল আর তাদের লালনপালন করা খামারিদের ওপর। 

জানা যাচ্ছে, সরকারি সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এনজিওগুলোর মাধ্যমে গরু–ছাগল পালনের জন্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা লগ্নি করেছে। স্থানীয় ছোট উদ্যোক্তা ও কৃষকদের ঋণ হিসেবে ওই টাকা দেওয়া হয়েছে। এখন বিদেশি গরুর মাংস আমদানি হলে তাঁরা মাঠে মারা পড়বেন। সরকারও মাঠ থেকে সেই টাকা তুলে আনতে পারবে না। 

যে দেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষ সরাসরি এবং ৪৫ শতাংশ মানুষ পরোক্ষভাবে গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া পালনের ওপর নির্ভরশীল, গত সাত বছরে যে দেশে প্রায় পাঁচ লাখ পরিবার গরু-ছাগল পালনে যুক্ত হয়েছে (যাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষিত তরুণ), সে দেশে এভাবে মাংস আমদানি করার ঘটনাকে সরল–সোজাভাবে নেওয়া মারাত্মক কঠিন। 

কাঁচা মাংসের মতো পচনশীল খাদ্যপণ্য আমদানি এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কতটুকু জীবাণুমুক্ত, তা পরীক্ষা–নিরীক্ষার যন্ত্রপাতিও আমাদের নেই। এই অবস্থায় কেউ যদি ‘মধু হই হই আঁরে বিষ’ খাওয়ায়ে দেয়, তখন তো ‘শোক সংবাদে’ পত্রিকার পাতা ভরে যাবে। ব্রাজিলের মাংস নিরাপদ নয় বলে যুক্তরাষ্ট্র ওই মাংস তাদের দেশে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। আর আমরা দেশের খামারিদের মাথায় বাড়ি দিয়ে এখন সেই দেশের মাংস আমদানির কথা ভাবছি। 

সরকারের মধ্যে যাঁরা গরুর মাংস আমদানি করার কাজ করছেন, তাঁদের বোঝা দরকার, গরু–ছাগলের সঙ্গে বাঙালির ‘নাড়ির টান’ আজকের না। ‘মহেশ’ নামের গরুকে সন্তানের মতো ‘পেলেপুষে’ বাংলার মনোজগতে গফুর মিঞা পারমানেন্ট জায়গা করে নিয়েছে। ব্যাকরণের পাঠে সন্ধির অধ্যায়ে ‘গবেষণা’-কে ভাঙলে দাঁড়ায় ‘গো+এষণা’ যার শাব্দিক মানে ‘গরু সন্ধান’। 

কথ্য বাংলাতেও ‘গরু খোঁজা’ (‘খোঁজা’র চন্দ্রবিন্দু বাদ দিলে অবশ্য এঁড়েকে বলদ বানানোর প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে) শব্দবন্ধ মনে পড়তে পারে। ফলে গরু নিয়ে গুরুতর চিন্তা করার সময় এসেছে। ছাগলকেও বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। খোদার খাসির মতো গো খাতকে ছেড়ে দিলে ‘গোয়াল ভরা গরু’র গৌরব হাতছাড়া হয়ে যাবে। ‘কাজির গরু’ যাতে কেতাব থেকে নেমে গোয়ালে থাকতে পারে, সেই দিকে মন দিতে হবে। নয়তো দেশের গো খাত গো-হারা হারবে। 

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক