বেলুনওয়ালার হাতে বোমা

রাসায়নিক গ্যাস দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করার পেশাটা কী ভীষণ প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে, তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত রাজধানীর মিরপুর এলাকার রূপনগরে গত বুধবারের ট্র্যাজেডি। এক বেলুন বিক্রেতার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে চারটি শিশু; বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাত। বেলুন বিক্রেতা নিজেসহ আহত হয়েছে মোট ২০ জন মানুষ। তাদের কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় বিস্ফোরণের শিকার শিশু–কিশোর ও অন্যদের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যাওয়া, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার যে চিত্র সংবামাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা যেন সন্ত্রাসবাদীদের আত্মঘাতী বোমা হামলাগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

এ ঘটনায় যদিও বেলুন বিক্রেতা নিজে নিহত হননি, তবু এটাকেও আত্মঘাতী বিস্ফোরণই বলতে হয়। কারণ, মৃতের তালিকার শুরুতেই থাকতে পারত তাঁর নিজের নাম। তিনি বেঁচে গেছেন একান্তই সৌভাগ্যক্রমে। তাঁর মতো আরও যেসব ব্যক্তি এভাবে জীবিকা উপার্জন করেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আসলে বোমা নিয়ে ঘোরেন। কারণ, বেলুন ফোলানোর জন্য গ্যাস তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে তাঁরা সাধারণভাবে অজ্ঞ। তাঁরা যেসব সিলিন্ডার ব্যবহার করেন, সেগুলো নিরাপদ নয়। কারণ, সেগুলোর অধিকাংশই যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডার। মেয়াদোত্তীর্ণ ও ব্যবহারের অনুযোগী সেসব সিলিন্ডার বেলুনওয়ালারা ব্যবহার করেন। আর কিছু সিলিন্ডার তৈরি করা হয় পরিত্যক্ত সিএনজি সিলিন্ডার কেটে। সেগুলো কতটা গ্যাসের চাপ বহন করতে সক্ষম, তা পরীক্ষা করা হয় না। 

বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডার ও যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা করে দেখার বিধান আছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে বিধান মানা হয় না। সেসব সিলিন্ডার জরাজীর্ণ হওয়ার একপর্যায়ে যখন আর ব্যবহারের কোনো উপায়ই থাকে না, তখন পরিত্যাগ করা হয়। সেসব পরিত্যক্ত সিলিন্ডার, কিংবা সেগুলো কেটে তৈরি করা সিলিন্ডার ব্যবহার করে বেলুনওয়ালারা শিশুদের জন্য মনোমুগ্ধকর বেলুন ফোলাতে গিয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ডেকে আনছেন। 

গ্যাস সিলিন্ডার নামক বিধ্বংসী বোমা সঙ্গে নিয়ে বেলুনওয়ালারা যখন পাড়া–মহল্লায় হাজির হন, তখন উৎসুক শিশুরা তাঁদের ঘিরে ধরে। যে বস্তিবাসী দরিদ্র শিশুর বেলুন কেনার পয়সা নেই, সে–ও নানা রঙের বেলুন দেখার জন্য বেলুনওয়ালার কাছে যায়। বুধবার রূপনগরে যখন বিস্ফোরণটি ঘটে, তখন শিশুরা বেলুনওয়ালাকে ঘিরে ছিল।

বেলুনওয়ালারা বেলুন ফোলানোর জন্য নিজেরাই অ্যাসিড, সিসা, দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি ধাতু ব্যবহার করে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করেন। কিন্তু তাঁরা এ প্রক্রিয়ার ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে কিছু জানেন না। বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যমান্য কিছু প্রক্রিয়া আছে। বেলুনওয়ালাদের সেসব প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, অনুসরণ করার কোনো কারিগরি সুবিধাও নেই। বিপদের বিষয় হলো, সিলিন্ডারে গ্যাস তৈরির উপাদানগুলোর মিশ্রণে গ্যাস উৎপন্ন হতে শুরু করলে তার চাপ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এ অবস্থায় বেলুন বিক্রি কম হলে অতিরিক্ত গ্যাসের চাপে সিলিন্ডারটির বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়তে থাকে।

পরদিনের সংবাদমাধ্যমে জানা গেল, ওই বেলুনওয়ালার বিরুদ্ধে পুলিশ অপরাধজনক নরহত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত বেলুনওয়ালাকে গ্রেপ্তার ঘোষণা করা হয়েছে। 

অপরাধ সংঘটিত হলে তার আইনি প্রতিকার স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশিত। কিন্তু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে যাওয়ার পর বিচার করে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে এ ধরনের দুর্ঘটনার পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া বেশি জরুরি। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের বক্তব্য হলো, অনুমোদন ছাড়া গ্যাস তৈরি করা নিষিদ্ধ। এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করাই সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য।