স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তা দরকার

রোহিঙ্গাদের দুঃখগাথা নিয়ে দেশ–বিদেশের গণমাধ্যমে অনেক তোলপাড় হয়েছে
রোহিঙ্গাদের দুঃখগাথা নিয়ে দেশ–বিদেশের গণমাধ্যমে অনেক তোলপাড় হয়েছে

১১ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অবস্থানজনিত বহুমাত্রিক প্রভাব ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে গণমাধ্যমে। তবে এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যাওয়া দূরে থাকুক, হ্রাসও পায়নি। মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একজনকেও এখন পর্যন্ত দেশটি ফিরিয়ে নেয়নি। মাঝেমধ্যে তালিকা নিলেও মিয়ানমার এ বিষয়ে এক রূপ নির্বিকারই থাকছে। প্রত্যাবাসন বিষয়ে পাশ্চাত্য বিশ্ব আমাদের অবস্থানকে সমর্থন দিলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাশিয়া, চীন ও ভারতের প্রয়োজনীয় সমর্থন পাচ্ছি না আমরা। তাই কোনো চাপে নেই মিয়ানমার।

রোহিঙ্গাদের দুঃখগাথা নিয়ে দেশ–বিদেশের গণমাধ্যমে অনেক তোলপাড় হয়েছে। তবে তারা যে জনপদটিতে আশ্রয় নিয়েছে, তার স্থানীয় অধিবাসীরা এসব বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেরা কোথায় নেমেছে, তা কিন্তু তেমন আলোচিত হয়নি। আর যেটুকু–বা হয়, তার বিহিত করার জন্য হয় না কোনো ব্যবস্থা।

অতি সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোতে ‘সঞ্চয় ভেঙেছেন ২৮ শতাংশ স্থানীয় মানুষ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন এসেছে। সেই প্রতিবেদন প্রণেতারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের উপদ্রুত এলাকা ব্যাপকভাবে ঘুরে দেখেছেন। কথা বলেছেন স্থানীয় অনেক বাসিন্দার সঙ্গে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ও এনজিও জোটের সমন্বয়কারীর মতামতও িনয়েছেন। আলোচনা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে। পাশাপাশি প্রামাণ্য তথ্যের জন্য তাঁরা নির্ভর করেছেন ‘বৈশ্বিক খাদ্য সংকট প্রতিবেদন-২০১৯’–এর ওপর। প্রতিবেদনটির ভূমিকা লিখেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। এটি যৌথভাবে প্রণয়ন করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউনিসেফসহ মোট আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। প্রতিবেদনে কক্সবাজারের স্থানীয় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা দিচ্ছে। শিবিরে আসার পর ৯১ শতাংশ রোহিঙ্গার খাদ্য পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা আসার পর স্থানীয় ব্যক্তিদের খাবার কেনার সামর্থ্য কমে গেছে। সামগ্রিকভাবে ৪৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীর হাতে খাবার কেনার যথেষ্ট অর্থ নেই।’ চলছেন ধার–দেনায় কিংবা সঞ্চয় ভেঙে।

যে কারও একটু শিউরে ওঠার কথা। আশ্রয়শিবিরের দুই উপজেলার জনসংখ্যা সাড়ে ৫ লাখের মতো। আর অতিথি এখন দ্বিগুণ। রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছে আমাদের দেশে। আশ্রয় দিয়েছে সরকার। সর্বতোভাবে সহায়তা দিয়েছে স্থানীয় জনগণ। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যও আসছে। অবশ্য তাদের অনেকের আবাসনব্যবস্থা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে খাদ্যপ্রাপ্তির বিবেচনায় তারা নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে ভালো আছে, এটা প্রতিবেদন থেকে সুস্পষ্ট, তা–ই থাকুক। সম্ভব হলে আরও বাড়ুক, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে এ সহায়তা কর্মসূচিকে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে স্থানীয় জনগণকেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা। ছিটেফোঁটা কিছু করা হলেও তেমন কিছু হয়নি। প্রতিবেদনই এটা জানান দিচ্ছে। আর ১৭ কোটি লোকের দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ছাপ শুধু বড় প্রকল্পে থাকবে কেন? এ সাড়ে ৫ লাখ লোকের জন্য কি বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? তাদের জন্য ব্যাপকভিত্তিক বিশেষ ভিজিএফ, কম মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ, নগদ সহায়তাসহ অনেক কিছু করা যায়। স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালুর কথা শুধু শুনছি। বিশেষ বিবেচনায় এ দুটি উপজেলায় দুপুরে স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করলে উপস্থিতির হার অনেক বেড়ে যাবে। খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও অনুকূল প্রভাব ফেলবে এ ধরনের কর্মসূচি। আর আমাদের অর্থনীতিতে এটা সম্ভব।

রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি করতে স্থানীয় ব্যক্তিদের কারও কারও ফসলি জমি গেছে। সেই আবাসস্থলের পাশাপাশি জমিগুলোও বর্জ্যে আবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। মিষ্টিপানির নিরাপদ উৎস বন্ধ বা দূষিত হয়ে পড়েছে পাহাড়ি ছড়াগুলো। এত লোকের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে ভূগর্ভে হানা দিয়ে কাজ চালাতে হয়। ফলে পানির স্তর ক্রম নিম্নমুখী। বনভূমি ও পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। রান্নার কাজে জ্বালানির জন্য এই অঞ্চল বরাবর নির্ভরশীল ছিল বনভূমির ওপর। হঠাৎ এত লোকের আগমন ও জ্বালানি সংগ্রহে উজাড় হয়ে গেছে বিরাট বনাঞ্চল। হাতিসহ বহু বন্য প্রাণী হয়ে পড়েছে বিপন্ন। একরূপ নিয়ন্ত্রণহীন রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বেআইনিভাবে ঢুকে পড়েছে স্থানীয় শ্রমবাজারে। ফলে মজুরি গেছে কমে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে স্থানীয় দিনমজুর শ্রেণির ওপর। ২০১৭ সাল থেকে মাছ ধরা বন্ধ আছে স্থানীয় নাফ নদীতে। অথচ এর ওপর নির্ভরশীল ছিল একটি বিরাট অংশের জনগণ। নিরাপত্তার পাশাপাশি ইয়াবা চোরাচালান বন্ধের জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এমনটি বলা হয়ে থাকে। অথচ ইয়াবা চোরাচালান কমেছে, এমনটা দাবি করা যাবে না। অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে এ নাফ নদী দিয়েই চালু রয়েছে সীমান্ত–বাণিজ্য। সে দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য নিজেদের জলসীমায় মাছ ধরার সুযোগ করতে পারলে বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থান হয়। তরকারিসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদনে এই অঞ্চল উদ্বৃত্ত ছিল। একটু কম দামেই স্থানীয় ব্যক্তিরা এগুলো কিনতে পারত। এখন এত লোকের চাহিদা মেটাতে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে এগুলোও আনতে হয়। স্বাভাবিকভাবে দাম গেছে চড়ে আর খেসারত দিচ্ছে স্থানীয় জনগণ। 

রোহিঙ্গাদের জন্য কিন্তু এগুলোর সম্ভাব্য দাম হিসাব করে জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন থেকে ক্যাম্প ইনচার্জদের মাধ্যমেই নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। চাল ছাড়াও রেশনে দেওয়া হয় ডাল, তেল, আটাসহ বেশ কিছু ভোগ্যপণ্য। বেশ কিছু এনজিও রয়েছে শুধু রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য। রোহিঙ্গা সমস্যার আকস্মিক কোনো সমাধানের সম্ভাবনা লক্ষণীয় নয়। আমরা এসব বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি। একটা গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা ছাড়া তাদের ফেলে দেওয়া যাবে না। সে জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের সহযোগিতাই বাংলাদেশের একমাত্র অবলম্বন। তাদের নিজ দেশে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনই আমাদের লক্ষ্য। সেটা কবে, কত দিনে হবে, এটা আমাদের অজানা। তাই যতক্ষণ সেটা না হয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ কিছু প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব ও সমীচীন। কিছু দেওয়া হয়। তবে সেটা অপ্রতুল। 

আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলোর বেশ কিছু স্থানীয় কর্মী আবশ্যক হয়। বারবার দাবি করা হয়েছিল সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কর্মী নিতে হবে স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে। দাবিটির যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় বিষয়টি। রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেও কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ তারা তো অনেক ধরনের ভোগ্যপণ্যই ত্রাণ সহায়তা হিসেবে পাচ্ছে। এ কাজগুলো স্থানীয় ব্যক্তিরা পেলে তাদের দুর্ভোগ কিছুটা কমত। স্থানীয় অবকাঠামো চুরমার হয়ে গেছে। এতে যাতায়াত ব্যয় ও সময় বেড়েছে। প্রভাব পড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যে। খেসারত দিচ্ছে স্থানীয় জনগণ। এভাবে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে তারা। মধ্যবিত্ত নেমে গেছে দরিদ্র শ্রেণিতে। শুরু থেকে সরকারি ত্রাণ বিতরণের সাংগঠনিক ব্যবস্থা তেমন কিছুই ছিল না। এদের ভাত–পানি–আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় ব্যক্তিরাই। আর আজ আমাদের সচেতনতার অভাবে এরা পায় না ঠিকমতো খেতে। একটি ইংরেজি দৈনিক এ–সংক্রান্ত খবরগুলো একটি শিরোনামে করে থাকে। শিরোনামটি হচ্ছে ‘কস্ট অব বিইং আ জেনেরাস হোস্ট’। এটা রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতীয়ভাবে আমাদের জন্য যতটা প্রযোজ্য, তার চেয়ে অধিক প্রযোজ্য সেই দুটি উপজেলার স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য। 

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব