বিচার কেন চাইতে হবে

বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হয়, কিন্তু তা নিয়ে সব সময় হইচই হয় না। কোনো কোনো খুনের ঘটনায় হঠাৎ সারা দেশ ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ‘বিচার চাই, ফাঁসি চাই’ স্লোগানে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুব সোচ্চার হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে কিছু ব্যতিক্রমী চিন্তার মানুষের দেখা পাওয়া যায়। তারা এত শোরগোল পছন্দ করে না। তারা বলে, ‘বিচার কেন চাইতে হবে?’

ধারণা করি, এই ধরনের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তবে তারা যে আছে, তা দেখতে পাওয়া যায়। কোনো চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যখন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভীষণ শোরগোল শুরু হয়, তখন তাদের কাউকে কাউকে দেখতে পাওয়া যায়।

কিন্তু কী বলতে চায় তারা? বিচার কেন চাইতে হবে—এটা কেমন ধারার প্রশ্ন? বিচার চাওয়ায় সমস্যা কী?

বিচার চাওয়ায় কোনো সমস্যা নেই। যে মানুষকে খুন করা হয়েছে, তার স্বজনেরা অবশ্যই বিচার চাইতে পারে, কিন্তু এটা নিয়ে গোটা সমাজকে সোচ্চার হয়ে উঠতে হবে? কেন ‘ফাঁসি চাই’ বলে মিছিল–সমাবেশ করতে হবে? মানববন্ধন করতে হবে? সড়ক অবরোধ করতে হবে? কেন সংবাদমাধ্যমকে শুধু এই একটা ঘটনা নিয়েই মেতে উঠতে হবে? অন্তত এক সপ্তাহ ধরে?

যারা এই ধারার প্রশ্ন তোলে, তাদের বক্তব্য এ রকম: কোনো মানুষ খুন হলে তার স্বজনেরা বিচার চেয়ে মামলা করবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সেই মামলার তদন্ত করবেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। মোদ্দাকথা, খুন–ধর্ষণসহ যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হলে রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অপরাধীর বিচার ও শাস্তি হবে। এ জন্য পুরো সমাজকে চিৎকার করতে হবে না।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করার পর যখন চারদিকে হত্যাকারীদের ‘ফাঁসি চাই’ রব উঠেছিল, তখন ফেসবুকে একজন লিখেছিলেন, ‘যারা ফাঁসি চাই বলে চিৎকার করে, বিচারব্যবস্থার প্রতি তাদের অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়।’ বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে যেসব মানুষ এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, এই রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার কাছে তাদের প্রত্যাশা খুব বেশি; এতটাই বেশি যে সন্দেহ জাগে: আসলেই কি এমন মানুষ আছে, যারা রাষ্ট্রের কাছে সব ধরনের ন্যায় মনেপ্রাণে প্রত্যাশা করে? অর্থাৎ, যারা বলে খুনির ফাঁসি বা বিচারের দাবিতে আন্দোলন–সংগ্রাম করার প্রয়োজন নেই, রাষ্ট্রের স্বাভাবিক দায়িত্বই হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, তারা কি আসলেই এসব কথা বলে আন্তরিক বিশ্বাস থেকে?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সমাজ মনস্তাত্ত্বিকদের গবেষণা জরিপের শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো গবেষণা এ দেশে কখনো হয়েছে বলে শুনিনি।

বিপরীত দিকের চিত্রটা মোটের ওপর পরিষ্কার: ফাঁসির দাবিতে সমাজে ও গণমাধ্যমে বড় রকমের তোলপাড় সৃষ্টি হলে কখনো কখনো খুব কম সময়ের মধ্যেই মামলার রায় ঘোষিত হতে পারে এবং আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ পাওয়া যেতে পারে। সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলার রায়। ১৬ জন আসামির প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনের চাপ এত তীব্র ছিল যে মাত্র ৩৩ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল। এই মামলার নিষ্পত্তি হতে সময় লেগেছে সাত মাসের কম; ৬১ কার্যদিবস শুনানির পর রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

বলা বাহুল্য, নুসরাত হত্যা মামলার এই দ্রুত নিষ্পত্তি ও সব আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার প্রচলিত স্বাভাবিক গতিতে হয়নি। কিন্তু যে নাগরিকদের রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা খুব বেশি, যারা প্রশ্ন তোলে বিচার কেন চাইতে হবে, তারা প্রতিটি অপরাধের আইনি প্রতিকারের এই দ্রুতগতি ও যথার্থ দণ্ড স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই আশা করে। আমাদের রাষ্ট্রে সে আশা যে প্রায় অসম্ভব উচ্চাশা, সেটাও হয়তো তারা জানে। তবু তারা বারবার এই কথাই বলে—বিচার কেন চাইতে হবে? আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই কেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে না?

বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন এ জন্য যে জনমতের প্রচণ্ড চাপ ছাড়া অধিকাংশ গুরুতর অপরাধের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে না; কিংবা হলেও খুব লম্বা সময় লেগে যাচ্ছে। স্বাভাবিক পন্থায় ও স্বাভাবিক গতিতে বিচার সম্পন্ন না হলে বলা যায় না যে আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার স্বাভাবিক সক্রিয়তা বজায় আছে।

আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য যখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদাধিকারীকে প্রকাশ্যে নির্দেশ দিতে হয়, যখন খোদ প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের উদ্দেশে এমন আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করতে হয় যে অপরাধী যে–ই হোক, তার শাস্তি হবে; তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থার স্বাভাবিক সক্রিয়তায় গুরুতর ঘাটতি রয়েছে। অপরাধীদের দণ্ড দেওয়ার জন্য যখন বিচারকদের ওপর জনমতের চাপ অবিকল্প হয়ে ওঠে, তখন বুঝে নিতে হয়, বিচারব্যবস্থায় স্বাভাবিকতার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থা যেভাবে যেটুকু কাজ করছে, তা করছে নিজের শক্তি–উদ্যম–উদ্দীপনার দ্বারা নয়, বরং বাইরের শক্তির চাপে ও প্রভাবে।

দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাত হত্যার ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নুসরাত হত্যার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা ছাড় পাবেন না; তাঁদের বিচার হবেই। শুধু তা–ই নয়, প্রধানমন্ত্রী হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা ও হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে এই তথ্য সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছিলেন এবং সংবাদমাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। আদালতের ওপরও যে গণমাধ্যমে প্রতিফলিত জনমতের চাপ বেশ ভালোভাবে পড়েছিল, তা স্পষ্ট হয় রায় ঘোষণার সময় বিচারকের বক্তব্য থেকে। বিচারক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘মিডিয়ার কারণেই বিশ্ব জানতে পেরেছে যে নুসরাত নামের একটি লড়াকু মেয়ে কীভাবে নিজের সম্ভ্রমের জন্য লড়াই করেছেন।’ এমনকি বিচারক এ কথাও উল্লেখ করেন যে ‘আসামিরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন।’ অর্থাৎ আইন–বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হতে পেরেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও জনমতের প্রবল চাপের মুখে।

আমাদের দেশে অপরাধের আইনি প্রতিকারের এ রকম ব্যতিক্রমী ঘটনা কালেভদ্রে ঘটে। এ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু এ রকম ব্যতিক্রমী তোলপাড় ছাড়া যদি খুন–ধর্ষণসহ অন্যান্য গুরুতর অপরাধের বিচার না হয়, তবে তা ভালো কথা নয়।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]