শরণার্থীর স্রোত ও মৃত্যুর মিছিল

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশের সময় মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে তাদের অনেকে ডুবে মারা যায়, এ খবর নতুন নয়। ইউরোপের নানা দেশের মহাসড়ক ও বন্দরেও শরণার্থীদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এবার যুক্তরাজ্যের এসেক্সে মালবাহী ট্রাকে পাওয়া গেল ৩৯ জন শরণার্থীর লাশ। যুক্তরাজ্যের এসেক্স শহরের পুলিশ জানিয়েছে, গত ২৩ অক্টোবর রাত পৌনে দুইটার দিকে লন্ডন থেকে ২০ মাইল দূরে এসেক্সের গ্রেস শহরের শিল্প এলাকায় একটি রেফ্রিজারেটেড লরির কনটেইনার থেকে ৩৯টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এই হতভাগ্য লোকজনের মধ্যে ৩১ জন পুরুষ ও ৮ জন নারী। তাঁরা চীন ও ভিয়েতনামের নাগরিক এবং তঁারা মানব পাচারের শিকার হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ আরও জানিয়েছে, ট্রাকটি বেলজিয়াম থেকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছিল। আয়ারল্যান্ডের সমুদ্রবন্দর হোলিহেড দিয়ে ২২ অক্টোবর রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেলজিয়ামের জিব্রেগা থেকে এসেক্সে এসে পৌঁছেছিল।

এসেক্সের এই মর্মান্তিক ঘটনার আগে ২০১৫ সালে একটি বরফায়িত পরিবহন ট্রাকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার অনতিদূরে ৭১ জন সিরীয় এবং ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের টিলবরি বন্দরে একটি জাহাজের কনটেইনারের ভেতর ৩৪ জন আফগান শরণার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০০০ সালেও যুক্তরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর ডোভারে টমেটোর ট্রাকে ৫৮ চীনা ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছিল ব্রিটিশ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

ইউরোপমুখী এই শরণার্থীদের স্রোত কীভাবে ঠেকানো যায়, তা নিয়ে ইউরোপের নানা দেশের নানা মত রয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়নবিষয়ক কর্মসূচির প্রধান আখিম স্টাইনার সম্প্রতি জার্মানির স্পিগেল পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রাচীর দিয়ে ইউরোপ অভিমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের স্রোত বন্ধ করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘের অভিবাসীবিষয়ক সংগঠন আইওএম জানিয়েছে, এ বছর শেষ হওয়ার আগেই এক হাজারের ওপর শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে মারা গেছে। তারপরও সমুদ্রপথে ৭৫ হাজার শরণার্থী ইউরোপে ঢুকতে পেরেছে। আর উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো ও স্পেনের মধ্যকার ছয় মিটার দীর্ঘ ধারালো কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ইউরোপে ঢুকেছে ৪ হাজার ৬০০ শরণার্থী।

আখিম স্টাইনার বলেছেন, এত কিছু করেও যখন শরণার্থীদের থামানো যাচ্ছে না, তখন ইউরোপীয় দেশগুলোর এখন উচিত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে শরণার্থী বা অভিবাসীবিষয়ক সমস্যার দ্রুত সমাধান করা। ২০১৫ সালের গ্রীষ্মে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধপীড়িত দেশগুলো থেকে লাখ লাখ শরণার্থী ইউরোপে ঢুকলে ইউরোপের অনেক দেশই মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয়। সে সময় শুধু জার্মানিই ১২ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। এতে জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন, কিন্তু নিজের দেশে কট্টরপন্থীদের রোষানলে পড়েছিলেন।

শুধু জার্মানি নয়, অভিবাসী–রাজনীতি নিয়ে মধ্য–উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের নানা দেশে কট্টরবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অথচ ৩০ বছর আগের পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর হাজার হাজার মানুষ অধিক গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পাশের পশ্চিমা দেশগুলোতে গিয়ে রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। এখন সেই পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভেনিয়ার মতো দেশগুলোই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার।

২০১৫ সালে ইউরোপমুখী শরণার্থীর স্রোত ঠেকাতে ইউরোপিয়ান কমিশনের সভাপতি জাঁ ক্লদ জাঙ্কারের নেতৃত্বে  জাঙ্কার কমিশন গঠিত হয়। ইইউ জোটভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে এই কমিশন তুরস্ক, মরক্কো, লিবিয়া, নাইজার ও সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে ইউরোপ অভিমুখী শরণার্থী ঠেকানোর প্রচেষ্টা নেয়। এতে শরণার্থীদের স্রোত কিছুটা কমে যায়। তারপরও সমুদ্র ও সড়কপথে অভিবাসীদের আসা বন্ধ হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন জানাচ্ছে, ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে ২০১৭ সালে ৩ হাজার ২৩৫ জন এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯৭ জন মারা গেছে। এদের অধিকাংশেরই মৃত্যু ঘটেছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে।

শরণার্থী বিষয়ে ইউরোপীয় কমিশনের জাঙ্কার কমিশন বারবার নানা উদ্যোগ নিলেও জোটভুক্ত কিছু দেশের অসহযোগিতার কারণে শরণার্থীদের পুনর্বাসনে ইউরোপীয় পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছে। জাতিসংঘের একটি নতুন সমীক্ষায় এখন দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় দেশগুলো শরণার্থীদের আসতে যত নিয়ম বা বাধার সৃষ্টি করুক, তবু শরণার্থীর স্রোত এবং দুর্গম পথে তাদের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘের উন্নয়নবিষয়ক কর্মসূচির প্রধান আখিম স্টাইনার তাই বলেছেন, ইউরোপের দেশগুলোর উচিত হবে একটি সুনির্দিষ্ট অভিবাসন নীতি পুনর্বিবেচনা করা।

সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান বা আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কেন এত উদ্বাস্তু জীবন বাজি রেখে নিজের জন্মভূমি ফেলে দুর্গম সাগর বা সড়কপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়াল, সেই আলোচনা ইউরোপে খুব কম। এই দেশগুলোর মানুষকে বাস্তুহারা করার পেছনে ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা আর ন্যাটো জোট তাদের ভুল যুদ্ধনীতি অস্বীকার করতে পারবে না। যুদ্ধের কারণে আজকের যে মানবিক সমস্যা, তাতে তাদের দায়ভারের কথাও ভাবতে হবে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]