পেঁয়াজের ব্যাপারীর জাহাজের খবর

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

হারি আপ ব্রাদার! অ্যাটেনশন প্লিজ—

বিলিভ মি, লেকচার আমি দিমু না। লেকচার আমি দিতে আসি নাই। মাগার ভাইয়া, পেঁয়াজের প্যাঁচে দ্যাশের ফাঁইস্যা যাওয়া দেইখ্যা দুই হরফ না কয়া উপায় নাই। কারেন্টের জালে আটকা খাওয়ার পর ভেটকি মাছ যেই তরিকায় দাঁত কেটকি মারে, পাবলিক অহন সেই দশায়। এই নিয়া বয়ান না দিলে হাজেরানে মজলিশ বইলা বসতে পারে, ‘এত্তো বড় ঝাঁজওয়ালা ইস্যু চাপা দিলা! এইডা একটা কাম করলা মিয়া?’ সো, দাদাভাই, গোল হয়া দাগের বাইরে দাঁড়ায়া, দুই হাতের বান্ধন ছাড়ায়া, কান দুইডা খাড়ায়া শোনেন।

পয়লা কথা হইলো, পেঁয়াজ একখান মারাত্মক মারফতি মাল (মসলাও কইতে পারেন)। সওয়াল উঠতে পারে, ‘মারফতি মাল আবার কেমন?’

দাদাভাই গো, যে জিনিসরে তালাশ না করলেই ধরা দিয়া থাকে, মাগার তালাশ করলেই উধাও হয়া যায়, সেই জিনিস হইলো মারফতি মাল। এই কারণে রবিঠাকুর পেঁয়াজের কথা মাথায় নিয়া লেখছিলেন,—‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে’। কারণ পেঁয়াজ হইতাছে সেই লাইনের জিনিস, যা এমনি কাটো-বাটো কোনো অসুবিধা নাই, সে ‘ধরা’র মধ্যে থাকবে। যেই তার মুখোশ খোলার খায়েশ হইলো, যেই জামা খোলার মতো তার খোসা খোলা শুরু করলা, ওমনি সে ‘অধরা’ হইতে থাকব। একটার পর একটা খোসা খুলবা, ভিতরে কোন জায়গায় পেঁয়াজ আছে, তাই তালাশ করতে থাকবা, শ্যাষম্যাশ দেখবা পেঁয়াজ-ফেয়াজ কিচ্ছু নাই। সব মায়া, ফলাফল—‘জিরো’। শ্যাষম্যাশ তোমারই ফয়সালা দিতে অইবো ‘জগতে পেঁয়াজ বইলা কিছু নাই’। পেঁয়াজ এই রকমের ‘ধরা-অধরার’ জিনিস।

পরশু দিনকার ঘটনা। ‘এই হোটেলে সুলভে খাইবার সুব্যবস্থা আছে’—সাইনবোর্ড দেইখা ঢুকছিলাম ভাতের হোটেলে। ঢুইক্যা দেখি খাবার টেবিলডার পর নোটিশ লটকানো—‘খাইবার সময় পেঁয়াজ চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’। এক কেজি পেঁয়াজের দাম যদি দেড় শ টাকা হয় তাইলে এই নোটিশ না টাঙ্গায়া উপায় আছে? হোটেলওয়ালা লজ্জা দিতে মানা করছে। আরে হুমুন্দি! লজ্জা দিমু কেমনে? আমার নিজের কাছে লজ্জা শরম থাকলে তো তরে দিমু! যারা পেঁয়াজ নিয়া লারাচারা করতাছেন তাগো কাছ থিকা কিছু লজ্জা শরম ধার কইরা হয়তো দিতে পারতাম। কিন্তু তারা তো পেঁয়াজ–রসুন ছাড়া আর কিছু মজুত করে না।

দাদাভাই, ইমানে কইতাছি, ভেলকি না দেখাইলে শিষ্যের কাছে গুরুর গুরত্ব থাকে না। এই কথা পেঁয়াজও বোঝে। এই কারণে ফি বছরই সে ভেলকি দেখায়। রমজান মাস তো পেঁয়াজের ভেলকি মৌসুম হইয়াই আছে। অ্যার বাইরেও সুযোগ আসলে সে হাতছাড়া করে না। তার গুরুত্ব সে দেখায়ে দেয়।

কোনো বছর চাউর হয়, ‘এই বছর বৃষ্টি বাদলা হয় নাই; ফলন মাইর খাইছে। অতএব ২০ টাকার পেঁয়াজ ৪০ টাকা।’ তার পরের বছর হয়তো শোনা যায়, ‘এ বছর বৃষ্টি বাদলার চোটে ফলন মাইর খাইছে। অতএব ২০ টাকার পেঁয়াজ ৬০ টাকা।’

এই বছর এই কায়দার আওয়াজ শোনা যায় নাই। বৃষ্টি বাদলার গল্প ছাড়াই পেঁয়াজ লাফানো শুরু করছিল। সেই লাফানি এখন দাপানিতে রূপ নিছে। পাবলিকের কাঁপানি উইঠা গেছে, দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে। পেঁয়াজ খাওয়া বাদ দিয়া তারা খাবি খাওয়া শুরু করছে। এই অবস্থা কদ্দিন চলব, তা কেউ কইবার না পারলেও উজির নাজিরের ‘গোল্লা কথা’ বন্ধ হচ্ছে না।

একেকজন একেক পদের লেকচার মাইরা যাচ্ছে। কেউ কয়, ‘আর কটা দিন সবুর করো পেঁয়াজ বুনেছি।’ কেউ কয়, ‘আমদানি নাই, তাই ঝাঁজ বাড়তাছে। এই তো, ইম্পোর্ট হইতাছে। খাতুনগঞ্জের আড়ত পেঁয়াজে পেঁয়াজে পেঁয়াজারণ্য কইরা ফেলব।’ অনেক আদার ব্যাপারী পর্যন্ত পেঁয়াজের জাহাজের খবর নিচ্ছে। কেউ কইতাছে, ‘সব সিন্ডিকেটের দোষ’। কেউ ধমকি দিতাছে, ‘এত্ত পেঁয়াজ ভদ্দরলোকে খায় নাকি? গালে গন্ধ হয় না! কম খান!’

সরকার নাকি তার সব যন্ত্রপাতি এক করে ঝাঁজ কমানোর চেষ্টা করতাছে। কিন্তু দাদাভাই, হিট তো কমার কোনো লক্ষণ দেখি না। পেঁয়াজের ঝাঁজে পাবলিক চোখ কচলাইতে কচলাইতে সমানে নজরুলগীতিতে টান মারতাছে, ‘নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখিজল’। কক্সবাজারে এক মণ লবণের বদলে এক কেজি পেঁয়াজও জুটতাছে না। লক্ষ্মীপুরে ডিমের মতো পেঁয়াজও হালি দরে বিক্রি হইছে। রায়পুরে এক হালি পেঁয়াজ ২০ টাকায় কেনাবেচা হইছে।

মানে, পেঁয়াজের পোয়া বারো থেকে সাঁইত্রিশে গিয়া ঠেকছে। মানে, ‘ভালো জিনিস যত বেশি হয় ততই ভালো’—এই পজিশনে সে আর নাই। বর্তমানে তার পজিশন হইল, ‘ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।’ পেঁয়াজ মনে করতাছে, যতক্ষণ সে পাবলিকের নাগালের বাইরে থাকব, যতক্ষণ সে পরিমাণে অল্প থাকব, ততক্ষণই তার কদর থাকব। ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর শুনতাছি মিয়ানমার, তুরস্ক আর মিসর থিকা পেঁয়াজ আনার জোগাড়যন্ত্র চলতাছে। সেই জোগাড়যন্ত্র কয় দফা পাবলিকরে যন্ত্রণা দিব, সেইটা কোটি টাকার সওয়াল। বাণিজ্যসচিব সাব কইছেন, এই মাসের শ্যাষে নাকি পেঁয়াজের টেনশন যাবেই যাবে।

কিন্তু দাদাভাই, পেঁয়াজের এই বিরহ এত দিন পাবলিকের মন মাইন্যা নিলেও দেহ মানতে পারব বইলা মনে হয় না। পাবলিকের মাথা গরম হইতাছে। গরম কাটানোর লাইগ্যা তাগো অহন বহুব্রীহি নাটকের মামার মতো উল্টা গোনা ছাড়া তো আর কোনো পথ নাই।

দাদাভাই, এই সোসাইটিতে যহন কেউ কোনো কিছুর দায় গ্রহণ করব না, খালি গ্রহণ লাগাইতে থাকব, খালি দাগা দিয়া দাগ মুছতে চাইব, তহন মনে মনে উল্টা গুনা ছাড়া কীই–বা করার আছে ব্রাদার! 

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক