'গণরুম' কালচার ও নতুন প্রজন্ম

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশে এখন একটা অস্থির সময় অতিবাহিত হচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, ক্রিকেট অঙ্গনের দুঃসংবাদ, হত্যা, ধর্ষণ, শিক্ষাঙ্গনে জবরদস্তি, নিষ্ঠুরতার চর্চা ইত্যাদি। বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যার পর উন্মোচিত হয়েছে সরকার–সমর্থক ছাত্রসংগঠনের একাংশের অপরাধমূলক কার্যকলাপের চিত্র। এটা শুধু ছাত্রদের অধঃপতনের দুয়ারে ঠেলে দেওয়ার চিত্রই নয়, তরুণ প্রজন্মকে অসুস্থ করে তোলারও চিত্র।

দুঃখজনক বিষয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও দলীয় রাজনৈতিক লাইনে বিভক্ত। তাঁরা শুধু শিক্ষকতা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারছেন না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদাধিকারী উপাচার্য যখন সেই পদ ছেড়ে সরকারপন্থী যুব সংগঠনের প্রধান হওয়ার অভিপ্রায় জনসমক্ষে প্রকাশ করেন, তখন বোঝা যায় শিক্ষকদের অবস্থান আজ কোথায়। কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও তাঁরা নিজ নিজ পদে বহাল আছেন। অন্য কোনো দেশ হলে তাঁরা পদত্যাগ করতেন। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এশিয়ার এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পায়নি। অথচ একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন পরিবেশ নেই, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা হলে থেকে নিশ্চিন্তে পড়াশোনা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারেন। প্রশ্ন উঠেছে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি পিএইচডি গবেষণা নকল বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য পদে নিজেদের অনুগত লোকদের নিয়োগ দেয়। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও বিদ্যাচর্চার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার পরিবর্তে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষকদের আধিপত্য ও প্রভাব প্রতিষ্ঠাতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। এই আধিপত্যেরই একটা প্রকাশ সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের নির্যাতনচর্চা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘র্যাগিং’ ও গণ ‘ড্রয়িংরুম’ কালচারের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা এককথায় ভয়াবহ। র‍্যাগিংয়ের শিকার হয় নতুন শিক্ষার্থীরা। তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়; অধিকাংশই সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই থাকতে হয়, কারণ তাদের পরিবার এতটা সচ্ছল নয় যে বাসা ভাড়া নিতে পারে। সেই শিক্ষার্থীরা হলে হলে যে নির্যাতনের শিকার হয়, তার বিবরণ শুধু করুণই নয়, লজ্জাকরও বটে। বিশেষত ছাত্রীদের যে ধরনের হেনস্তা, অবমাননাকর, এমনকি যৌন হয়রানির মধ্যে যেতে হয়, তার বিশদ বিবরণ উঠে এসেছে বিবিসি বাংলার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে (২৫ অক্টোবর ২০১৯: বিবিসি বাংলার সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটের প্রবাহ অনুষ্ঠান)।

বিবিসির প্রতিবেদক কয়েক ভুক্তভোগী ছাত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এক ছাত্রী বলেছেন যে কীভাবে হলে সিট দেওয়ার নাম করে ‘বড় আপুরা’ তাঁদের ওপর মানসিক নির্যাতন চালান। তাঁদের বেছে বেছে সাজিয়ে–গুজিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ছাত্রাবাসে ছাত্ররাজনীতির বড় ভাইদের কথিত মিটিংয়ে। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে যে ধরনের আলোচনা ও অঙ্গভঙ্গি করা হয়, তা ছাত্রীদের কাছে অবমাননাকর মনে হয়। আরও কয়েকজন সাক্ষাৎকারে একই কথা ব্যক্ত করেছেন। শুধু বড় ভাইদেরই নয়, তাঁদের ওপরের নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়ে যাওয়া হয় বলে সাক্ষাৎকারে ভুক্তভোগী ছাত্রীরা বলেছেন। একটি ছাত্রী কাঁদো কাঁদো স্বরে বলেছেন কীভাবে তাঁদের প্রায় ছয় ঘণ্টা ‘অলংকারের মতো’ সাজিয়ে ১০০ টাকা করে কথিত বড় ভাইয়েরা হাতে দিয়েছেন। তাতে তাঁদের সবাই তাঁদের ভাষ্যমতে, অপমানিত বোধ করেছেন। তঁদের মধ্যে হতাশা ও হীনম্মন্যতা ভর করেছে।

বিবিসির প্রতিবেদক বলেছেন, হলের প্রভোস্টরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। অনেক প্রভোস্ট বলেছেন, তাঁরা এসব অভিযোগ শোনেননি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বিগত এক দশকে ক্রমেই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার পেছনে রয়েছে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠন। এসব অভিযোগ যে সত্য, তার প্রমাণ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর দ্বারা এক ছাত্রীর মানসিক ও দৈহিক নিগৃহীত হওয়ার পর আত্মহননের চেষ্টার খবর। অভিযুক্ত ছাত্রদের মধ্যে তিনজনকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এক বছর কেন? জনগণের করের টাকায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ছাত্রছাত্রী নামধারীদের পড়তে দেওয়াই উচিত নয়।

নারীদের ওপর এ ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ধিক্কারজনক। যখন সরকার সমাজে নারীদের মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে সব ধরনের প্রয়াস নিচ্ছে, তখন সরকার–সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের এহেন কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরাও এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস দেখাতে পারেন বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় দেশের উচ্চশিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হবে, এমনটা আশা করা যায় না।

বাংলাদেশে এখন এমন আদর্শবান ব্যক্তিত্বের খুব অভাব, যাঁরা আগামী প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন। একসময় যাঁদের ছাত্রসমাজে অনুকরণীয় মনে হতো, তাঁদের বেশির ভাগ ভ্রষ্ট রাজনীতির আবর্তে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছেন বা গেছেন। বর্তমান প্রজন্ম তাই দিশেহারা ও রাজনীতিবিমুখ।

শিক্ষাঙ্গনের এই নৈরাজ্যের কারণে রাষ্ট্র মেধাশূন্য হচ্ছে। এমন নয় যে আমাদের তরুণদের মেধা নেই। মেধা তাদের যথেষ্টই আছে, কিন্তু সমাজ, রাজনীতি ও বিশেষত শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ সে মেধা বিকাশের অনুকূল নয়। আমাদের মেধাবী তরুণেরাই বিদেশের শিক্ষাঙ্গন আলোকিত করে সেখানকার সমাজকে সমৃদ্ধ করছেন। আমরা তাঁদের স্বদেশের কাজে লাগাতে পারছি না। এ দেশে এখন মেধার সমাদর নেই; রাজনৈতিক আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কাছে মেধা হেরে যাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে হতাশা ভর করলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও দেশের সৃজনশীল শক্তির ঘাটতি হতেই থাকবে।

তথাপি আমরা আশা করি, সরকার এ বিষয়ে কঠিন পদক্ষেপ নেবে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে হতাশার হাত থেকে রক্ষা করবে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, ছাত্রছাত্রীদের মানোন্নয়নে ‘গণরুম কালচার’ শুধু বন্ধ করাই নয়, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
hhintlbd@yahoo. com