ফিলিস্তিনকে দমানোর অস্ত্র সহায়তা তহবিল

ক্যাপশন রয়টার্স ফাইল ছবি।
ক্যাপশন রয়টার্স ফাইল ছবি।

জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াবিষয়ক বিশেষ সমন্বয়ক নিকোলাই ম্লাদিনোভ নিরাপত্তা পরিষদে গাজা ভূখণ্ড নিয়ে সম্প্রতি একটি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিটির বক্তব্য যদি তিনি একটু ব্যাখ্যা করতেন এবং সব ফিলিস্তিনের স্বার্থের কথা যদি বিবৃতিটিতে উঠে আসত, তাহলে বেশ ভালো হতো।

ম্লাদিনোভ বলেছেন, গাজার মানবিক সংকট নিরসনকেই তাঁরা অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে রেখেছেন। তবে তিনি মনে করেন, ‘গাজার সংকটের মূল হলো রাজনৈতিক’।

আসল কথা হলো ইহুদিবাদী ঔপনিবেশিক প্রকল্পের বিভিন্ন ফাউন্ডেশনকে বিচার–বিবেচনা ছাড়াই অনুমোদন ও সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনিদের মানবিক সংকটময় পরিস্থিতির ভেতর ঠেলে দিয়েছে।

১৯৪৭ সালের ভূখণ্ড ভাগ পরিকল্পনার কয়েক দশক পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুই রাষ্ট্র গঠনবিষয়ক সমঝোতার ধারণা ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি জাতিসংঘ গত কয়েক দশকে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার জন্য ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়ার বিষয়কে আমলে নেয়নি।

আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রমের প্রধান সুবিধাভোগী দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ভিত্তিতে বিশ্বকে দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আসছে। ফিলিস্তিন গোটা বিশ্বকে বারবার মনে করিয়ে আসছে, দুই রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা তাদের রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারছে না। কিন্তু এ বিষয়ে বিশ্ব সব সময়ই উদাসীন থেকেছে।

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম নেহাতই একটি আপৎকালীন প্রচেষ্টা। ইসরায়েলের প্রতি জাতিসংঘের নিঃশর্ত সমর্থন এই প্রচেষ্টার আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দিহান করে তোলে। এই মানবিক সহায়তার ওপর ফিলিস্তিনের নির্ভরশীলতা বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে রাজনৈতিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি ম্লাদিনোভের ভাষণে অনুপস্থিত ছিল।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব সময় বলে এসেছে দুই রাষ্ট্র গঠনই ‘একমাত্র সমাধান’। এই সমঝোতা প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সম্মতি দিয়ে আসছে। কিন্তু সেই সমাধান প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন না করে বিশ্বনেতারা যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে এসেছেন। ম্লাদিনোভের বক্তব্যে এই বিষয় একবারও উঠে আসেনি।

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা মানবিক সহায়তাদানের ফায়দা তুলতে একটুও ছাড় দিচ্ছেন না। এই সহায়তার ওপরই সমস্যার বিশালত্ব দাঁড়িয়ে আছে। মানবিক সহায়তা গ্রহণের কারণেই ফিলিস্তিনকে অনন্তকালের জন্য ইসরায়েলের উপনিবেশ হিসেবে আটকে থাকতে হচ্ছে।

ফিলিস্তিনিরা যদি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বঞ্চনা ও পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পায়, তাহলে ইসরায়েলের সেই উপনিবেশের অবসান হবে। এ কারণেই মানবিক সহায়তার সুবিধাভোগী তকমা থেকে ফিলিস্তিনকে বের করে আনার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।

এই মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতাই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে খণ্ডিত রাখতে ভূমিকা রাখছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গাজা ভূখণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।

২০১৪ সালে ইসরায়েল গাজায় ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’ নামের প্রায় ৫০ দিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী সামরিক অভিযান চালানোর সময় জাতিসংঘ বলেছিল, ২০২০ সালে গাজা ভূখণ্ড বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে যাবে। এর দুই বছর আগে ২০১২ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে ঠিক একই কথা বলা হয়েছিল। এটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরায়েল গাজায় বারবার হামলা চালিয়েছে। এতে কি মনে হয় না যে জাতিসংঘ গাজায় ইসরায়েলের উপনিবেশকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে?

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার মিখায়েল লিনক বলেছেন, ‘ইসরায়েলের অনন্তকালীন দখলদারির সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অগণিত প্রস্তাব পাস করেছে এবং অসংখ্য ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সেই সমালোচনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’

এই এত দিনে জাতিসংঘের আচরণে মনে হচ্ছে ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তার ওপর চিরকাল নির্ভরশীল রাখাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এ সহায়তা মূলত তাদের ইসরায়েলি আধিপত্যের কাছে মাথা নত রাখার মোক্ষম অস্ত্র, যা যত দিন সম্ভব ব্যবহার করা হবে। 

মিডল ইস্ট মিরর থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত 

রামোনা ওয়াদি ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও লেখক