মোবাইল কোর্ট চলুক হাইকোর্টের অধীনে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের এক যুগ পূর্তির তারিখ ১ নভেম্বর নীরবে চলে গেল। সংশ্লিষ্টদের সম্ভবত বলার তেমন কিছু ছিল না। আমরা সম্ভবত মেনে নিয়েছি যে বিশ্বের অন্য কোথাও না থাকলেও বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা মোবাইল কোর্ট চালাবেন। সুতরাং করণীয় কী?

এক যুগের অভিজ্ঞতায় একটা বাস্তবসম্মত সমাধানসূত্র হাজির করা ছাড়া আর তো গত্যন্তর দেখি না। সে কারণেই কয়েকটি জরুরি কথা পরিষ্কার করে বলা। বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণ নিয়ে এর আগে যত লেখা লিখেছি, তাতে অধস্তন আদালতের প্রায় আঠারো শ বিচারক নিয়েই কথা বলেছি। এবার তা করব না। শুধু জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে বলব। তাঁরা সংখ্যায় ছয় শর বেশি। গত ১২ বছরে তাঁদের ঘাড়ে মামলা চেপেছে ৮৮ লাখের বেশি। তাঁদের মামলা নিষ্পত্তির হার গড়ে ৯৫ শতাংশের বেশি। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট একরামুল হক শামীম হিসাব করে বের করেছেন যে ২০০৮ সালে ম্যাজিস্ট্রেসির নিষ্পত্তির হার ছিল ৮৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। পরের ১২ বছরের মধ্যে এমন তিনটি বছর কেটেছে, যখন নিষ্পত্তির হার ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

এই ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোই সিংহভাগ মামলার প্রবেশদ্বার। তাঁরা অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড দিতে পারেন। এই রকম অপরাধের বিচারের পাশাপাশি তাঁরা মামলা গ্রহণ, জামিন, পিটিশন, নারাজি ইত্যাদি শুনানি করেন। আমরা প্রস্তাব দিই, তাঁদের দিয়েই মোবাইল কোর্ট চালানো হোক। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভ্যান নামিয়েছেন। আমাদের এখানেও নামুক। হাইকোর্টের মোবাইল কোর্ট মানে হাইকোর্ট–নিয়ন্ত্রিত মোবাইল কোর্ট। তাঁরা সপ্তাহের এক–দুই দিন উপজেলা সদরগুলোয় যাবেন। ওই ভ্যানের মধ্যে লিগ্যাল এইডের আইনজীবীরা থাকবেন। যাঁরা আইনজীবী নিয়োগে অপারগ, তাঁরা আইনি সহায়তা পাবেন। সমাজে এ মুহূর্তে সবচেয়ে যা বেশি দরকার তা হলো, ন্যায়বিচারের বোধ। রাষ্ট্রযন্ত্রের যে অঙ্গীকার আছে, সেটা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে প্রকাশ করা। কিন্তু যাচ্ছি যেন আমরা উল্টো দিকে। ভয় দেখিয়ে ন্যায়বিচার হবে না। ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে শান্তি আসবে না। মোবাইল কোর্টের তাৎক্ষণিক বিচারের দর্শন আসলে ভীতি ছড়ানোর দর্শন। ভয় দেখানোর যন্ত্রগুলো জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা আত্মঘাতী। বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান নারী নির্যাতন, ধর্ষণের রাশ টানেনি।

আমরা অবশ্যই দ্রুত বিচার চাই। হাইকোর্টের মোবাইল কোর্টগুলো সীমিত ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক রায় দেবেন। কিন্তু তাঁরা তা দেবেন দেশের প্রচলিত আইনের আওতায়। প্রমাণ দিতে হবে যে দেশের প্রচলিত আইনের অধীনেও দ্রুত বিচার করা যায়। কিন্তু তাতে ভুল বা গুরুতর ভুল আদেশের আশঙ্কা কম। এই প্রস্তাব আমরা সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে বলি। বিশেষ করে, সুপ্রিম কোর্ট বারসহ বার কাউন্সিল ও জেলা বারগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে পারে। তারা প্রস্তাব তুললে হাইকোর্টের পক্ষে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ করবেন। অধস্তন আদালত মানে যাঁরা ম্যাজিস্ট্রেসি চালান। সেই অর্থে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, তা তাঁরা যে যেখানেই থাকুন না কেন, যাঁদের আমরা ঈদে বা অন্য সময়ে ভেজাল খাবার, ভেজাল ওষুধ ধরা বা র‌্যাবের সঙ্গে ক্যাসিনো অভিযানে দেখি, তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের দায় হাইকোর্টের ওপর আপনা–আপনি বর্তায়। এখন তা শুধু জনপ্রশাসনই করছে। কেউ বলতে পারেন তাঁরা সেটা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করছেন। কিন্তু সংবিধান তাঁদের সেই দায়িত্ব দেয়নি। কারণ, ম্যাজিস্ট্রেসি নিয়ন্ত্রণ করার ভার সংবিধান নির্দিষ্টভাবে হাইকোর্ট বিভাগকে দিয়েছে।

সরাসরি নয়, কথাটা একটু ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বুঝতে হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আইনের সৃষ্টি। তাঁরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন মোবাইল কোর্ট আইনের অধীনে। সেই আইনে বলা আছে, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটরা যেসব ক্ষমতার অনুশীলন করতে পারেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কেবল তেমন ক্ষমতারই অনুশীলন করতে পারবেন। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটরা সংবিধানসম্মত বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। সে জন্য তাঁরা একটা জবাবদিহির পরিমণ্ডলে বিচরণ করেন। এখানে ক্যাডারের ব্যাপার নেই। জুডিশিয়াল ক্যাডার বলেই হাইকোর্টের অধীনতা নয়। মূলত তাঁরা প্রজাতন্ত্রের বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন বলেই তাঁরা হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং যাঁরাই যখন যে নামে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন, তাঁরা আপনা–আপনি হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবেন।

কিন্তু আমরা গত ১২ বছরে বুঝতে পারি, এটা নির্বাহী বিভাগ মানবে না। তারা মোবাইল কোর্টের শুনানি করায় বিমুখ থাকবে। প্রশ্ন হলো, আমরা নাগরিকেরা শুধুই নীরব দর্শক হিসেবে বসে থাকব, নাকি যতটুকু করা সম্ভব, সেটুকু চেষ্টা করব। উপরন্তু আমরা দেখেছি যে ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইন যেসব শর্ত দিয়ে অপরাধ আমলে নিতে বলেছে, সেটা চরমভাবে কিংবা নির্বিচার লঙ্ঘন ঘটছে। অথচ কতিপয় অপরাধের তাৎক্ষণিক বা দ্রুত বিচার জরুরি। কিন্তু সেই প্রয়োজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা পূরণ করতে পারছেন না। আমরা একটা পদ্ধতিগত প্রতারণা দেখছি। হাইকোর্টের মোবাইল কোর্ট বাতিল করা রায়টি কিন্তু সব সমস্যা বিবেচনায় নেয়নি।

কিন্তু এখন যেভাবে মোবাইল কোর্ট চলছে, তাতে আমজনতার পক্ষেও সহজে বোঝা সম্ভব যে, মোবাইল কোর্ট ন্যায়বিচার দিচ্ছেন না। তাঁরা আইনের শর্ত মানছেন না। আইন বলেছে, কোনো অপরাধ ‘তাহার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের) সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্‌ঘাটিত হইয়া থাকিলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, দোষী সাব্যস্ত করিয়া, এই আইনের নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করিতে পারিবেন।’ কিন্তু আমরা দেখছি, এর অহরহ লঙ্ঘন ঘটছে। আইনজীবী রাখার নিয়ম রাখা হয়নি, কারণ ধরে নেওয়া হয়েছে যাঁরা দোষ অস্বীকার করবেন, তাঁদের অপরাধের বিচার তাঁরা নিয়মিত আদালতে পাঠাবেন।

বিশেষ করে ‘স্বীকারোক্তি’ বলতে এখানে স্বতঃপ্রণোদিত স্বীকারোক্তি। অথচ দণ্ডদানের আদেশগুলোতে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে নির্দিষ্টভাবে কী অভিযোগ আনা হয়েছে, আর তিনি কী ভাষায় কী স্বীকার করেছেন, তা বোঝা যায় না। কারণ, তার বিবরণ লেখা হয় না। কাউকে জেল দেওয়া হলো ৭ দিন কি ১৫ দিন বা এক মাস। বিচার বিভাগের কাছে আসামির সহজে আসার উপায় নেই। কারণ, এক মাসেও আদেশের কপি দেওয়া হয় না। আদেশের কপি পেতে জেল খাটা সারা। অথচ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা রায় না লিখে সাধারণত রায় ঘোষণা করেন না। ব্যতিক্রম বা অনিয়মকারীদের বাদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রায় ঘোষণার পরে দু–এক কর্মদিবসের মধ্যেই আদেশের নকল পাওয়া যায়। উপরন্তু মোবাইল কোর্ট আইনে সম্পূর্ণ অহেতুক সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে ‘শুদ্ধ বিচারের’ নামে আরও একটি ধাপ তৈরি করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু জানতেন আপিলের স্তর বাড়লে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। মানুষের আয়ু কমে। মামলার আয়ু আরও বাড়ে। সেই কারণে তিনি সুপ্রিম কোর্টই করতে চাননি। চেয়েছিলেন শুধু হাইকোর্ট হোক। আর এখন মোবাইল কোর্টে চুরির দায়ে দণ্ডিতরাও জামিনের দরখাস্ত করতে পারেন না। কারণ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের কপি ছাড়া অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (এডিএম) কাছে আপিল করা যায় না।

আমরা এমন ব্যাখ্যাকে তাই অগ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখব, যদি দাবি করা হয়, হাইকোর্টের কাছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা এডিএমের কোনো জবাবদিহি নেই। কারণ, মোবাইল কোর্ট আইনে তা লেখা নেই। সংবিধান বড় নাকি মোবাইল কোর্ট বা রুলস অব বিজনেস বড়? অবশ্যই সংবিধান বড়।

আজ সংবিধান দিবস। তাই এদিনে আসুন, আমরা নতুন করে শপথ নিই সংবিধান সমুন্নত রাখার।

পরিবেশ আদালত, খাদ্য আদালতের মতো বিশেষ আইনগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা আছে। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে বিশেষ আইনগুলোর অধীনে এসবই কার্যকর করা হোক। আমাদের প্রস্তাবের সপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের একটি সিদ্ধান্ত হাজির করছি। ২০০৮ সালের ১৯ মার্চ আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্রসচিবকে ওই সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। আইন ও বিচার বিভাগের বর্তমান যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহার সই করা ওই চিঠিতে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে বিচারাধীন মামলাসমূহ বিচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অনুমতি প্রদান করেছেন। এটা কিছুদিন কাজ করে থেমে যায়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশ্নবিদ্ধ সমান্তরাল বিচারব্যবস্থার অবসান ঘটাতে উল্লিখিত মোবাইল কোর্টের পুনরুজ্জীবন দরকার। 

মিজানুর রহমান খানপ্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক