কেন রেল বিভাগের উন্নতি হয় না

পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোতে রেলপথের ভূমিকা অনেক
পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোতে রেলপথের ভূমিকা অনেক

বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে গণপরিবহন খাতে সমস্যার শেষ নেই। সড়ক যোগাযোগের ওপর অত্যধিক চাপের ফলে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের গতি অনেক কমে এসেছে। এই চাপ অনেকটাই কমে যেত, যদি আমাদের রেল সার্ভিস আরেকটু উন্নত হতো।

পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোতে রেলপথের ভূমিকা বিরাট, কারণ একটি ট্রেনে একসঙ্গে অনেক যাত্রী চলাচল করতে পারে। আমাদের দেশে রেল খাত একসময় লাভজনক ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন তা লোকসানি খাত। মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, জীর্ণ কারখানা, লোকবল–সংকট, সময়ানুবর্তিতার অভাব, টিকিট কেনায় দুর্ভোগ, ছারপোকাময় আসনই হচ্ছে রেলওয়ের বৈশিষ্ট্য।

ট্রেনে চড়লে সিট পাওয়া যায় না, এটা প্রতিদিনের ছবি। স্টেশন ও কোটাভিত্তিক টিকিট কেনাবেচার কারণে বছর বছর লোকসান বাড়ছে। ২০১৪ সালে অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসে ৩৫ শতাংশ, যমুনা এক্সপ্রেসে ৭ শতাংশ, এগারসিন্দুর গোধূলিতে ৩৮ ও ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসে ২৫ শতাংশ আসন ফাঁকা গেছে। ২০১৫ সালে সুবর্ণ এক্সপ্রেসে ১৫ শতাংশ, অগ্নিবীণায় ৩২ শতাংশ, যমুনায় ১৫ শতাংশ, এগারসিন্দুরে ৩৩ শতাংশ ও ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসে ৩২ শতাংশ। একই দশা ছিল অন্যান্য এক্সপ্রেসেও। যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করলেও কর্তৃপক্ষ শতভাগ টিকিট বিক্রি দেখাতে পারে না। কেন?

হাজার কোটি টাকার রেললাইন সংস্কার, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও অবকাঠামোয় ব্যয় হয়েছে। তবু ১৯৯০–এর দশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যেখানে পাঁচ ঘণ্টা লাগত, এখন সেখানে লাগে সাত-আট ঘণ্টা। এখন ৭০-৭৫ শতাংশ ট্রেন সময় মেনে চলাচল করে। ২০০৮-০৯ সালে ট্রেনগুলোর তা মেনে চলার হার ছিল ৮৩ শতাংশ।

রেলের জমি নিয়ে চলছে দখল–বাণিজ্য, ইজারা জালিয়াতি, লাইসেন্স ফি না দেওয়া, জমি ফেলে রাখা ও দুর্নীতি। তাই শেলটেকের জরিপে ১৮৭১ একর জমি খুঁজে পাওয়া যায় না। ট্রেনে পরিবহনের খরচ সড়কপথের চেয়ে অনেক কম। চাঁদাবাজি ও দুর্ঘটনার ভয় নেই বললেই চলে। যাত্রীবাহী ট্রেনের চেয়ে পণ্যবাহী ট্রেনের আয় চার গুণ বেশি। অথচ ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে ছিল ৪৮ লাখ ৭৯ হাজার টন আর ২০১৩-১৪ সালে ৩০-৩৫ গুণ বড় অর্থনীতির যুগে তা কমে ২২ লাখ টনে নেমেছে। উল্টো স্টেশনগুলোতে কনটেইনার রাখার জায়গাই সংকুচিত হচ্ছে।

সৈয়দপুর রেল কারখানায় মেশিন আছে ৭৪০টি। বয়স ৮০-১৪০ বছর। ১৪০ বছরের পুরোনো ক্যারেজ শপ, কালার শপ ও ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন মেশিন শপে কোচ মেরামত হচ্ছে। কোচ পারাপারে ব্যবহৃত হচ্ছে ৮৭ বছরের পুরোনো বৈদ্যুতিক ট্রাভারসার। পাহাড়তলীতে আছে ৪৩১টি মেশিন। সেই মেশিনগুলোর বয়সও ৫০-৬০ বছর। সৈয়দপুর, পার্বতীপুর ও পাহাড়তলীতে লোকবলের ঘাটতি যথাক্রমে ৫৫, ৪১ ও ৪২ শতাংশ। অথচ সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় বাজেট, জনবল, কাঁচামাল ও আধুনিক মেশিন থাকলে বিপুলসংখ্যক কোচ ও ওয়াগন তৈরির পাশাপাশি রপ্তানিও করা যেত।

চাহিদার অতিরিক্ত উপকরণ ক্রয়ে ২০১৫ সালে ক্ষতি হয়েছে ২৭৭ দশমিক ৬১ কোটি টাকা। মোট প্রকল্প ব্যয় থেকে পরামর্শক ব্যয় হয়েছে ২০১০, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে যথাক্রমে ৩৫.৪ শতাংশ, ১০ শতাংশ, ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ ও ২৯ দশমিক ৯১ শতাংশ। বালিশ–কাণ্ড থেকে বর্তমান পরামর্শক ব্যয় কত, বুঝে নেওয়া যায়। অর্থাৎ রেলের জমির সুষ্ঠু ব্যবহার, পণ্যবাহী ট্রেন, স্টেশনে ওয়াগন ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, কারখানাগুলোর আধুনিকায়ন, জনবল নিয়োগ, উপকরণ ক্রয়ে অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ ও পরামর্শক খাতে ব্যয় ন্যূনতম করলেই রেলকে লাভজনক করা সম্ভব।

ভারতেও একসময় রেলের অবস্থা খারাপ ছিল। ভারত সরকারের মোহন কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, যেভাবে চলছে তাতে ভারতীয় রেলওয়ে খুব দ্রুত দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ভারত সরকারকে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য ৬১ হাজার কোটি রুপির দেনার ভার বহন করতে হবে।...পরিচালনার পর্যায় থেকে দেখলে প্রতিষ্ঠানটি চির ঋণের ফাঁদে পড়েছে এবং শুধু ভর্তুকির মাধ্যমেই এটিকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে।

এরপর ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারতীয় রেলওয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ফলে ২০০৪ সালে ৯ হাজার কোটি, ২০০৫ সালে ১৪ হাজার কোটি, ২০০৬ সালে ২০ হাজার কোটি, ২০০৭ সালে ২৫ হাজার কোটি রুপি উদ্বৃত্ত হয়। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে যাত্রীভাড়া কমায়। প্রস্তাবিত ছাঁটাইয়ের বদলে ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়। কারখানা বেসরকারীকরণের বিপরীতে ডিজেল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিন, চাকা, যাত্রীবাহী কোচ তৈরির সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নতুন কারখানা নির্মাণের পাশাপাশি রুগ্‌ণ কারখানা অধিগ্রহণ করা হয়। যাত্রীভাড়া কমিয়ে ও সেবা বাড়িয়ে লাভজনক করা হয়। মালামাল পরিবহনের উন্নয়ন ঘটিয়ে রেলের আয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি হয়।

ভারতে যদি রেলের এই উন্নতি সাধন সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশে তা না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আন্তরিকভাবে চাইলে অবশ্যই রেলকে লাভজনক করা সম্ভব। সে জন্য বিদ্যমান সম্পদ ও অবকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

রেল বিভাগে দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপক; সবকিছুর আগে দুর্নীতি বন্ধ করা দরকার; মানুষ টিকিট কিনতে গিয়ে পায় না, কিন্তু ফাঁকা আসন নিয়ে ট্রেন চলাচল করে—এই অবস্থার জন্য দায়ী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থাপনা উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। ব্যবস্থাপনা উন্নত করার জন্য প্রত্যেকের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত করা হলে ট্রেনের এই দুরবস্থা হতে পারত না।

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি