মধ্যপ্রাচ্যে ওবামার মতো ট্রাম্পও ভুল করছেন

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

কয়েক দিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, উত্তর–পূর্ব সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর অভিযানে আইএস নেতা আবু বকর আল–বাগদাদি নিহত হয়েছেন। বাগদাদিকে হত্যায় মার্কিন কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য রাশিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক এবং সিরিয়ান কুর্দিদের ট্রাম্প অশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়ার দুই সপ্তাহ পরই বাগদাদিকে হত্যা করার খবর আইএসের বিরুদ্ধে পাঁচ বছর ধরে চালানো মার্কিন তৎপরতার সমাপ্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে।

তবে মধ্যপ্রাচ্যকে যে অবস্থায় রেখে মার্কিন বাহিনী সরে যাচ্ছে, তাতে সেখানে সংঘাতের সমাপ্তি হবে বলে মনে হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ২০১০ সালে বারাক ওবামা যে ভুল করেছিলেন, সেই একই ভুল ট্রাম্প করতে যাচ্ছেন।

ট্রাম্প বরাবরই ওবামার মধ্যপ্রাচ্য নীতির সমালোচনা করে এসেছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেই নীতিই তিনি অনুসরণ করছেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওবামা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ক্ষমতায় এসে তিনি দাবি করেন, ইরাক থেকে আল–কায়েদার মূলোৎপাটন করা হয়েছে এবং ইরাকি সরকার নিজেরাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। এই দাবি করে তিনি ২০১১ সালের মধ্যে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। ২০১১ সালের মে মাসে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার ঘটনা ওবামাকে সেনা প্রত্যাহারের সমালোচনা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু ২০১৩ সালে আল–কায়েদা আইএসের পতাকা নিয়ে আরও ভয়াবহ চেহারা নিয়ে হাজির হলো। ২০১৪ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া ইরাকি সেনাদের হটিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় বড় শহর মসুল দখল করে নিল। এর কয়েক দিন পরই মসুলের বিখ্যাত আল নুরি মসজিদে বাগদাদি একটি খিলাফত রাষ্ট্রের ঘোষণা দিলেন।

মসুল পতন ছিল ওবামা প্রশাসনের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আবার ইরাকে মার্কিন বাহিনী মোতায়েন করে। আইএস উৎখাতে ২০১৪ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি জোট বাহিনী গঠন করা হয়।

এর পাঁচ বছর পর ট্রাম্প ঘোষণা করলেন, আইএস ‘শতভাগ’ পরাজিত হয়েছে এবং তিনি মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। ওবামা যেভাবে তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য সেনা প্রত্যাহার করেছিলেন, ঠিক একইভাবে প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য ট্রাম্প সেনা সরিয়ে আনছেন। সমালোচকদের মুখ বন্ধ রাখতে ট্রাম্প তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সিরিয়ায় আইএস দমনে সিরীয় বাহিনীর অভিযানের প্রস্তাবকে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু তুরস্কের এই প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় সমস্যা কমেনি বরং বেড়েছে। তুরস্ক সিরিয়ায় আইএসবিরোধী অভিযানের নামে কুর্দিদের ওপর নির্বিচার হামলা শুরু করেছেন। ট্রাম্পকে এখন সমালোচকেরা এই বলে আক্রমণ করা শুরু করছেন যে তিনি আইএসবিরোধী যুদ্ধে কুর্দি মিত্রদের তুরস্কের কাছে বেচে দিয়েছেন। পরিস্থিতি সামলাতে গত মাসে ট্রাম্প তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে আঙ্কারা পাঠিয়েছিলেন। সেখানে পেন্স তুরস্কের নেতাদের কুর্দি নিধন না করার জন্য রাজি করিয়েছেন বলে হোয়াইট হাউস থেকে বলা হচ্ছে।

আঙ্কারায় পেন্স-এরদোয়ান বৈঠকের মাত্র ১০ দিন পর এবং সোচিতে এরদোয়ান-পুতিনের বৈঠকের সাত দিন পর তুর্কি সীমান্তের কাছে সিরিয়ার ভূখণ্ডে বাগদাদি নিহত হন। এটি থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, বাগদাদির অবস্থান আগে থেকেই তুরস্ক ও রাশিয়া জানত। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে তুরস্ক বাগদাদির খবর মার্কিন বাহিনীকে দিয়েছে। বিনিময়ে কুর্দি বিদ্রোহীদের নিধন করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা অনাপত্তিপত্র আদায় করে নিয়েছে।

বর্তমানে সিরিয়া এবং ইরাকের সব অবস্থান থেকেই আইএস বিতাড়িত হয়েছে। তাদের হাজার হাজার একনিষ্ঠ যোদ্ধা নিহত হয়েছে। বাগদাদি নিহত হওয়া তাদের জন্য বিরাট আঘাত, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। এরপরও আইএস মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তারা ছত্রভঙ্গ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আবার অনুকূল পরিবেশ পেলেই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে যাবে।

সে কারণে সিরিয়া থেকে মার্কিন বাহিনী যদি পুরোপুরি সরিয়ে আনা হয়, তাহলে তা তাদের আবার সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেবে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যকে সংঘাতের হাত থেকে বাঁচাতে একটি আঞ্চলিক সামরিক শক্তি গঠন করা দরকার, যা দীর্ঘ মেয়াদে আইএসবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত থাকবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মারওয়ান কাবালান: সিরিয়ার লেখক ও সাংবাদিক এবং আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজের পলিসি অ্যানালাইসিসের পরিচালক