আটকে আছে ৬১ জনের ভবিষ্যৎ

বিসিএসে নিয়োগ আটকে রয়েছে অনেকের।
বিসিএসে নিয়োগ আটকে রয়েছে অনেকের।

৩৭তম বিসিএসে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বিভিন্ন পদে ১ হাজার ৩১৪ জনকে নিয়োগে সুপারিশ করে। সুপারিশের পর হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা। পাশাপাশি চলে স্বভাবচরিত্র নিয়ে তদন্ত। নয় মাস সময় নিয়ে এগুলো নিষ্পত্তি করে গত এপ্রিলে সরকার ১ হাজার ২২১ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দেয়। এ বিষয়ে প্রথম আলোয় সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, তেমন কোনো যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকেই বাদ রাখা হয়েছে ৬১ জনের নিয়োগ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এগুলো আরও পর্যালোচনা করে দেখছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাদ পড়া প্রার্থীদের মধ্যে প্রশাসনে ১৩, শিক্ষায় ১০, পুলিশে ২, চিকিৎসক ১৪, কৃষিতে ২ জনসহ অন্যান্য ক্যাডারের প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তবে বিরূপ প্রতিবেদন রয়েছে বলে তাঁরা চাকরি না–ও পেতে পারেন, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, এ–জাতীয় স্বভাবচরিত্রগত প্রতিবেদন ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে এককভাবে পুলিশই করে আসছিল। দেখার থাকে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থী কোনো নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি কি না। সংশ্লিষ্ট আছেন বা ছিলেন কি না দেশের নিরাপত্তা ও সংহতির পরিপন্থী কোনো সংগঠনের সঙ্গে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ রয়েছে, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে পুলিশের নেতিবাচক কোনো প্রতিবেদন নেই।

ইদানীং জেলা প্রশাসনও এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। জেলা প্রশাসনকে গোয়েন্দা তথ্য দেওয়ার জন্য আইনানুগভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা পুলিশের বিশেষ শাখা। তা তারা নিয়মিতই দেয়। এর বাইরে অন্য কোনো উৎস থেকে প্রতিবেদন তৈরি করা হলে যে সতর্কতা প্রয়োজন, তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা বা অনুরূপ কোনো উৎস থেকে প্রতিবেদন নেওয়া হলে তা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মনে হচ্ছে, এমন কিছু ঘটে চলেছে। সেদিনও সরকারপ্রধান এক আলোচনায় বলেছেন, কোনো কর্মকর্তার ভিন্ন কোনো ধরনের রাজনৈতিক মত থাকতে পারে। তা চাকরিক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হবে না। এ ঘোষণার পর তো বিষয়টি নতুনভাবে তলিয়ে দেখার দাবি রাখে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঠেকে, এই ৬১ জনের কয়েকজন নন-ক্যাডার সরকারি চাকরি করছেন যথাযথ পুলিশি তদন্তের পরই। সে ক্ষেত্রে বিসিএসের প্রার্থীদের জন্য পুলিশ প্রতিবেদন ছাড়াও তদন্তের ভিন্ন সংস্থা থাকলে বিবেচনার মানদণ্ডে তো একই হওয়ার কথা। স্বাভাবিকভাবে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক কোনো বিবেচনা থেকে এখনো নিয়োগ পাননি বর্ণিত ৬১ জন।

সবচেয়ে বড় বিষয়, প্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স চলে যাওয়ার কথা। তাঁরা এ পর্যায়ে এসেছেন সফল দীর্ঘ পথপরিক্রমার পর। পিএসসি ৩৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। প্রথম পর্যায়ে প্রার্থী সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫৩ হাজার। সে বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। এর ফলাফল বিবেচনায় ৮ হাজার ৫২৩ জনকে লিখিত পরীক্ষায় ডাকা হয়। ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে উত্তীর্ণ হন ৫ হাজার ৩৭৯ জন প্রার্থী। সে বছরের নভেম্বর থেকে শুরু হয় মৌখিক পরীক্ষা। আর ২০১৮ সালের ১২ জুন পিএসসি চূড়ান্ত সুপারিশ পাঠায় সরকার বরাবর। আড়াই লাখ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তাঁরা এ স্তরে পৌঁছেছেন। যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তঁাদের কাউকে চাকরিবঞ্চিত করা কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

শুধু ৩৭তম বিসিএস নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে এ প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে বাড়ছে এর পরিসর। এ ধরনের প্রতিবেদনের জন্য স্বভাবচরিত্রগত যে মানদণ্ড প্রয়োজন, তা কারও না থাকলে তাঁকে নির্দ্বিধায় বাদ দেওয়া যেতে পারে। অথবা ইতিবাচক নজর দেওয়া দরকার এঁদের যৌক্তিক অধিকারের প্রতি। এ শতাব্দীতেই বাংলাদেশের বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে দলীয়করণ প্রকট রূপ ধারণ করেছে। এখন সরকার তার মূল বা সহযোগী সংগঠনগুলোয় অনুপ্রবেশের কথা বলছে। স্পষ্টই তা ঘটেছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাঁদের থাকার কথা, তাঁরা ঠিকই আগেভাগে নির্দিষ্ট স্থান বা ব্যক্তিকে ‘ম্যানেজ’ করে নীরবে ইতিবাচক প্রতিবেদন অর্জন করেছেন। এর মধ্যে ঢুকে পড়েছেন চাকরিতে। আর যাঁরা নেহাতই কোনো দ্বিধায় ছিলেন না, তাঁরা পড়েছেন এরূপ বিপাকে। এমনটা এবারেই প্রথম ঘটছে না; হালের সব বিসিএসেই এমনটা ঘটেছে। এমনকি জুডিশিয়াল সার্ভিসেও। আবার বেশ ঘাঁটাঘাঁটির পর বেশ কয়েকটি ইতিবাচকভাবে নিষ্পত্তি করা হয়।

জানা যায়, এখন শুধু প্রার্থীর স্বভাবচরিত্রগত দিকটি দেখা হয় না; দেখা হয় তাঁর পারিবারিক আদ্যোপান্ত। কোনো প্রার্থীর দূরসম্পর্কের কোনো আত্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী হলেও সেই প্রার্থীকে সন্দেহভাজন তালিকায় নেওয়া হয়েছে। অথচ এখন প্রশাসনে যাঁরা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন, তাঁরা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন স্বৈরশাসক এরশাদের সময়। তাঁদের অনেকেই ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এমনকি কেউ কেউ ছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। এসব কোনো বাধা হয়নি তাঁদের চাকরিপ্রাপ্তিতে। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সময় ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি আমলেও সরকারবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করা সংগঠনের নেতা–কর্মীরা শুধু এ কারণে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হননি। আর স্বাধীন বাংলাদেশে চাকরিপ্রাপ্তির এই হাল! যথাযথ পুলিশ প্রতিবেদন নিয়ে যাঁরা সরকারি চাকরি করছেন, বিসিএসে নিয়োগে তাঁদের কী বাধা হতে পারে, এটা বোধগম্য নয়। ৬১ জনের মধ্যে তাঁদের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়। তবে এ তদন্তের গুণগত মান পর্যালোচনার জন্য যথেষ্ট।

সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরা জানেন, যখন যে সরকার আসে, চাকুরেরা তাদের আদেশ–নির্দেশই মেনে চলেন। আগেও তা–ই হয়েছে। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ সমর্থন করলেও কর্মক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত ছাড়া এর কোনো ছাপ পড়ে না। বস্তুতপক্ষে নিরাপদে চাকরি করে জীবিকা অর্জন করতে চান তাঁরা। চান সরকারি চাকরির সুনাম–সুখ্যাতি। পাশাপাশি অনেকেই জনকল্যাণমূলক কাজও করেন। সরকারগুলো তাঁদের অধিক পরিমাণে দলীয় কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট না করলে প্রজাতন্ত্র অধিকতর লাভবান হতো। আর নিয়োগ পর্বে এ ধরনের বাছাই কত ক্ষতিকর, তা ব্যাখ্যা করে বলার আবশ্যকতা নেই।

যাঁরা এখনো নিয়োগ পাননি, তাঁদের বয়স ত্রিশের কোঠায়। কেউ সংসারী হয়েছেন। উচ্চতর চাকরির হাতছানি নিজেদের পাশাপাশি তাঁদের মা–বাবা ও স্বজনকে পুলকিত করেছিল। সামনে দেখছিলেন সোনালি দিনের স্বপ্ন। প্রায় আট মাস আগে তাঁদের সহযোদ্ধারা নিয়োগ পেয়ে গেছেন। আর এই ৬১ জনের সাফল্যের চাঁদের আলো আকস্মিক ঢেকে গেছে মেঘে। মেঘ কাটার সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। বিসিএস পরীক্ষার এতগুলো স্তর উত্তীর্ণ হয়ে আসা সহজ কথা নয়। অবশ্যই তাঁরা কৃতিত্বের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছেন দুর্গম পারাবার। কিন্তু এখনো প্রবেশ করতে পারছেন না সে পারাবারের নির্দিষ্ট ঠিকানায়। কবে পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না, তা–ও নিশ্চিত নয়।

এটা বহুলভাবে আলোচিত হয় যে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে না আমাদের কর্মসংস্থান। তার মধ্যে সরকারই এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। সেখানে যাঁদের জন্য পদগুলো সংরক্ষিত আছে, যাঁরা সব যোগ্যতা অর্জন করেছেন সে পদে, তাঁদের এ ধরনের প্রতিবেদনের জন্য বাদ পড়ার বাঁধা দূর হওয়া সংগত।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]