আশাহীন পৃথিবীতে হেমন্তের বিক্ষোভ

চিলি, হংকং ও লেবাননের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি, রয়টার্স
চিলি, হংকং ও লেবাননের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি, রয়টার্স

বিক্ষোভের কাল চলছে বিশ্বে। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। নয়া উদারবাদের উন্নয়নের নামে ছদ্ম ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। হংকং থেকে বার্সেলোনা, বাগদাদ থেকে সান্তিয়াগো, বৈরুত থেকে আদ্দিস আবাবা, পুয়ের্তোরিকো থেকে হাইতি ও ইকুয়েডর এবং সর্বশেষ এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে পাকিস্তান। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে লাখো জনতা পথে। বিশাল বিশাল জনসমাবেশ হচ্ছে। গণ-আন্দোলনের মুখে চিলির মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে কিছুদিন আগে। চিলির জলবায়ু সম্মেলনও বাতিল করা হয়েছে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি পদত্যাগ করেছেন।

বিশ্বজুড়েই এই আন্দোলন বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো প্রত্যাখ্যানের ফল। সমসাময়িককালে একই সঙ্গে বা কাছাকাছি সময়ে বিভিন্ন দেশে যুগপৎ এমন বিক্ষোভ দেখা যায়নি। আরব বসন্ত একবার বিশ্বকে জাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আইসিস, আইএস, দায়েশ, খলিফা আল বাগদাদি, কুর্দি বিভিন্ন ইস্যু দিয়ে আরব বসন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আরব বসন্ত যেখানে আটকে গিয়েছিল, সেখান থেকেই এবার হেমন্তের বিপ্লব শুরু হয়েছে। এবারের বিক্ষোভ কেবল আরবেই সীমাবদ্ধ না। বরং বিশ্বের নানা শহর জেগে উঠেছে। বৈষম্য, দুঃশাসন, শোষণের বিরুদ্ধে লাখো মানুষ পথে নেমেছে।

কয়েক দশক ধরেই জীবনযাত্রার মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় পরিস্থিতিকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। নয়া উদারবাদ ও পুঁজিবাদ সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা, অতিমাত্রায় মুনাফার মনোবৃত্তি এবং অসমতা পৃথিবীর ইতিহাসে এখন সর্বোচ্চ অবস্থায় আছে। সারা বিশ্বেই বেকারত্ব বাড়ছে। যোগ্য লোকের নিম্ন মজুরির চাকরিতে প্রবেশও বাড়ছে। পুঁজিবাদ ও নয়া উদারতাবাদ ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমালেও দারিদ্র্য খুব বেশি কমাতে পারেনি—অন্তত উন্নয়নের যে হিসাব-নিকাশ দেওয়া হয় সেই অনুসারে। পরিবেশ ও প্রকৃতির চরম বিনাশ হচ্ছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধিত হলেও শ্রমিক শ্রেণির ওপর নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি ও চাকরিচ্যুতি বেড়েছে। সব মিলে সারা বিশ্ব বিশাল এক উন্নয়নের ফাঁদে পড়েছে। সবকিছু গিলে খাচ্ছে এই ফাঁদ। উদার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে। দেশে দেশে লোকরঞ্জনবাদের বিস্তার ঘটছে। রাষ্ট্রের দখলদারি মনোভাব, বর্ণবাদ ও যুদ্ধংদেহী আচরণকে উসকে দিচ্ছে মুনাফানির্ভর নয়া উদারবাদ অর্থনৈতিক কাঠামো।

নয়া উদারবাদ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কোনো যৌক্তিক সমাধান উপস্থাপন করতে পারেনি। বরং শোষণের নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছে। হংকং, প্যারিস, বার্সেলোনা, বাগদাদ, বৈরুত বা সান্তিয়াগোর সংগ্রাম ও আন্দোলনের শ্রেণি ও চরিত্র কমবেশি একই। হংকং ফুঁসে উঠেছে নতুন আইনের বিরুদ্ধে। গত বছরের নভেম্বরে প্যারিসে রায়ট শুরু হয়েছিল জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। সান্তিয়াগোর জনতা বিদ্রোহ করেছে মেট্রোরেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে। দীর্ঘ সময় গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত ইরাকিরা ভালো থাকার আশায়, ভালো খাদ্যের জন্য, চাকরির সন্ধানে বিক্ষোভ করছে। সেখানে এখন পর্যন্ত নিহত মানুষের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। বৈরুতে আন্দোলনে হচ্ছে রাষ্ট্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য।

ইরাক, বৈরুতে না হয় অর্থনৈতিক সমস্যা আছে। কিন্তু প্যারিস, হংকং বা সান্তিয়াগোতে কেন বিক্ষোভ হচ্ছে? এই তিনটি শহরকে উন্নত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু নয়া উদারবাদ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কমবেশি সবাই আক্রান্ত। এ ব্যবস্থায় উন্নয়নের ভাগ সবার দুয়ারে পৌঁছে না। সাম্প্রতিক আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে অনলাইনভিত্তিক বিশ্লেষণাত্মক পত্রিকা ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’-এ প্রবন্ধ লিখেছেন জেফরি ডি স্যাকস। এখানে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি, মোট দেশজ উৎপাদন এগুলো অর্থনীতির সার্বিক অবস্থাকে তুলে ধরে। কিন্তু সম্পদের সুষম বণ্টনের হিসাব নিকাশ নিশ্চিত করে না। তাই সান্তিয়াগো, প্যারিস বা হংকংয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন হচ্ছে। মোদ্দা কথা, নয়া উদারতাবাদ নানাভাবে নাগরিকদের শৃঙ্খলিত করে ফেলছে। পছন্দ প্রকাশের কোনো সুযোগ থাকে না নাগরিকদের। প্যারিসের মাথাপিছু আয় ৬০ হাজার ডলার, হংকংয়ের ৪০ হাজার এবং সান্তিয়াগোর ১৮ হাজার ডলার। সন্দেহ নেই অর্থনৈতিকভাবে এরা সমৃদ্ধ। কিন্তু এই তিন শহরের অভিবাসীরা তাদের জীবনযাত্রার মান নিয়ে তৃপ্ত না। হংকংয়ে যদি রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা থাকে, তবে সান্তিয়াগো ও প্যারিসে অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিরতাকে উসকে দিয়েছে।

নয়া উদারতাবাদের ফাঁকি হচ্ছে, উন্নয়নের ডামাডোল তৃপ্তি দেবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে হরণ করবে। বাসা ভাড়া দিচ্ছেন তো বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে। বিদ্যুৎ বিল দিয়েছেন তো ওষুধ কিনতে পারছেন না। কিন্তু এই সূচকনির্ভর অর্থনীতির উন্নয়ন গিলতে হবে বা গিলতে বাধ্য করা হবে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে উন্নয়নবিরোধী বলে চিহ্নিত করা হবে। সিংহভাগ সম্পদ গুটিকয় মানুষের কর্তৃত্বে চলে যাচ্ছে। নব্য ধনিক শ্রেণি, শাসক শ্রেণির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সমাজে কর্তৃত্ববাদী শোষণের বিকাশ ঘটাচ্ছে। যখনই কোনো বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়, শোষক শ্রেণি উন্নয়নবিরোধী, দেশবিরোধী নানা আখ্যা দিয়ে দমনের চেষ্টা করে। লেবানন, ইরাক, হংকং বা চিলিতে দমনের চেষ্টা করা হয়েছে।

নয়া উদারবাদের সরাসরি প্রভাব দুটি। এক. সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি। দুই. দমনমূলক নীতির মধ্য দিয়ে বিশ্বকে এক নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। ফ্যাসিবাদ আবার টেনে নিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধের দিকে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ থেকে বার্সেলোনার বিক্ষোভ, সবই সমাজের কাঠামোগত ত্রুটির ফলাফল। যে দেশগুলোতে বিক্ষোভ হচ্ছে বা যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে, ওই দেশগুলোতে কমবেশি নির্বাচিত সরকার আছে। কিন্তু জনসাধারণের কথা নির্বাচিত সরকারগুলো শুনছে না। এই যে রাষ্ট্র ও নাগরিকের বিভাজন, এটাই নয়া উদারবাদের ব্যর্থতা। রাষ্ট্রকে নাগরিকের বা নাগরিককে রাষ্ট্রের করে তুলতে পারেনি নয়া উদারবাদ। বলা হয়ে থাকে, নয়া উদারবাদের সব থেকে সফল প্রয়োগ হয়েছে চীনে। গত কয়েক দশকে চীন অর্থনীতির সূচকে তাবড় তাবড় সব অর্থনৈতিক শক্তিকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু বেখেয়াল হলে চলবে না যে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকা সর্বত্রই চীনের অর্থনৈতিক থাবা দৃশ্যমান। কোথাও কোথাও চীনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও হয়েছে।

নয়া উদারাবাদ অর্থনৈতিক কাঠামো একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে ব্যর্থ। এর যৌক্তিক উদাহরণ হচ্ছে চীন। উন্নয়নের কথা বলে উইঘুরদের বন্দী করা হচ্ছে। উন্নয়নের কথা সবাই বলে। কিন্তু উন্নয়নের পেছনের অন্ধকারকে কেউ দেখে না। তিয়েনআনমেন চত্বরের কথা সবাই ভুলে যায়। গুম হওয়া সেই বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের কথা কেউ মনে রাখে না। শুধু চীন না, অনেক দেশেই উন্নয়নের কথা বলে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করা হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়ন কি শোষণ, বৈষম্য ও নির্যাতনকে আড়াল করে রাখতে পারে?

ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে, পারে না বলেই সময় সময়ই মানুষ জেগে ওঠে। এই জেগে ওঠার জন্য অপেক্ষা কেবল।

ড. মারুফ মল্লিক : ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন