সাংবাদিকতার কি মৃত্যু ঘটতে চলেছে?

‘ইজ জার্নালিজম ডায়িং?’—এই বাক্যটা গুগল সার্চ ইঞ্জিনে লিখে ফলাফলের দিকে তাকালাম। এক সেকেন্ড না পেরোতেই প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ লিঙ্কের পথ দেখাল গুগল। এ থেকে বোঝা যায়, সাংবাদিকতার অস্তিত্বের সংকট কী ব্যাপক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সংকট এত গুরুতর যে ‘মৃত্যু’ শব্দটাই ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রশ্ন জেগেছে, পেশা হিসেবে কি সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটতে চলেছে?

কিন্তু কেন এই অলক্ষুনে প্রশ্ন? সাংবাদিকতার কি মৃত্যু হতে পারে? তাহলে গণতন্ত্রের কী হবে? রাষ্ট্রশাসনে, ক্ষমতার ব্যবহারে, আইন প্রয়োগে, জনগণের করের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির কী হবে? রাজনৈতিক অধিকার, মানবিক অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, তথ্য জানার অধিকার—এসবের কী হবে? মোদ্দা কথা, সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা ছাড়া পৃথিবী চলবে কী করে?

সাংবাদিকতার মৃত্যুতুল্য সংকটের সঙ্গে এই সব প্রশ্নসহ আরও অজস্র প্রশ্ন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। তাই খতিয়ে দেখা দরকার, কেন ও কী পরিস্থিতিতে এই প্রশ্ন উঠেছে। প্রথম আলোর ২১তম বর্ষপূর্তির আগের দিন, ৩ নভেম্বর ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম এক সাক্ষাৎকারে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ও বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সামনে কয়েকটা বড় চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছেন। একটা চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক: বিশ্বজুড়ের জবরদস্ত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনেতারা সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হচ্ছেন কটু কথা আর কালাকানুন নিয়ে। সাংবাদিকদের ‘পৃথিবীর নিকৃষ্টতম জীব’ বলে গালি দিচ্ছেন স্বাধীন সাংবাদিকতার তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। দেশে দেশে এমন সব কঠোর কালাকানুন জারি করা হচ্ছে, যার বলে সাংবাদিকদের কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে কারাগারে আটকে রাখা যায়; জব্দ করা যায় প্রকাশনার সরঞ্জাম। এমনকি সাংবাদিকদের গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগেও বিচার করে শাস্তি দেওয়ার আইনি হাতিয়ার আমদানি করা হয়েছে।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটা এসেছে প্রযুক্তির জগৎ থেকে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অভূতপূর্ব প্রসারের ফলে তথ্য, খবর ও মতামত বিনিময় এখন আর শুধু সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; সাংবাদিকতার সঙ্গে লেশমাত্র সম্পর্ক নেই, এমন মাধ্যমেও চোখের পলকে এই সবকিছুর আদান-প্রদান সম্ভব হচ্ছে। পশ্চিমা জগতের সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যম শিল্পে এই চ্যালেঞ্জই সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। একসময়ের ডাকসাইটে সংবাদপত্র ও টিভি স্টেশনগুলোর আয় এত দ্রুত গতিতে কমে গেছে যে তারা এখন অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি। ২০০৫ সালের পর এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর সব বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠান লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার একসময়ের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সংবাদপত্রগুলোর অন্যতম নিউইয়র্ক টাইমস ২০০৬ সালে আয় করেছিল ২১৫ কোটি ৩০ লাখ ৯৪ হাজার মার্কিন ডলার; ২০১৫ সালে তার আয় কমে গিয়ে নামে মাত্র ৬৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭১ হাজার ডলারে।

আমেরিকার আরেক শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট-এর দুর্দশা হয়েছে আরও মর্মান্তিক। মালিকেরা লোকসান টানতে না পেরে পত্রিকাটি বিক্রি করে দিয়েছেন; সেটা কিনে নিয়েছেন আমাজনের ধনাঢ্য মালিক জেফ বেজোস। কিন্তু তিনিও পত্রিকাটির লোকসান থামানোর পথ খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছেন। ওদিকে ব্রিটেনের অন্যতম মর্যাদাবান দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর ছাপা সংস্করণের মৃত্যু ঘটেছে। এখন শুধু অনলাইন সংস্করণ টিকে আছে; এই পরিণতি ঘটার আগে পত্রিকাটির মালিকানা বদল হয়েছে একাধিকবার। সবশেষে এটি কিনে নিয়েছেন এক ভুঁইফোড় রুশ ধনকুবের। লোকসান কমানোর উদ্দেশ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সাংবাদিককে ছাঁটাই করেছেন; কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি। এভাবে তিনি এটা কত দিন চালাবেন, বলা কঠিন।

ব্রিটেনের প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো সংবাদপত্র গার্ডিয়ান শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, এ পত্রিকারও লোকসানের ভার বিরাট। দুর্দশা এমন মর্মান্তিক যে গার্ডিয়ান পাঠকদের কাছে চাঁদার আবেদন জানাচ্ছে। ব্যাপক লোকসান সামলে টিকে থাকার জন্য গার্ডিয়ানকে আগের চেহারা বদলাতে হয়েছে। পত্রিকাটি আগে ছিল ব্রডশিট আকারের; এখন ছাপা হয় ট্যাবলয়েড বা কমপ্যাক্ট আকারে। তারা নিজেদের ছাপাখানাও তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে; এখন এটি ছাপা হয় মিরর গ্রুপের ছাপাখানায়। খরচ কমানোর জন্য অনেক সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে; ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া এখনো চলছে। পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালে ঘোষণা দিয়েছিল, পরের তিন বছরের মধ্যে ২০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করা হবে এবং ২০ শতাংশ ব্যয় কমানো হবে। এ বছরের ডিসেম্বর শেষ হলে তারা হিসাব করে দেখবে ব্যয় ২০ শতাংশ কমেছে কি না। শুধু সংবাদপত্র নয়, বিশ্বজুড়ে বড় টেলিভিশন স্টেশনগুলোর আয়ও ভীষণভাবে কমে গেছে এবং কমে যাওয়ার ধারাই অব্যাহত আছে।

প্রশ্ন হলো, ইউরোপ-আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় এভাবে কমে যাওয়ার কারণ কী? ওই সব দেশের মানুষের কি সংবাদের চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে? না। তা মোটেও নয়। সংবাদ ও তার বিশ্লেষণের চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা একটুও কমেনি। ব্যাপার হলো, সংবাদ পাওয়ার জন্য লোকজনকে এখন আর শুধুই সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না; তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো থেকে সবই পাচ্ছে। সংবাদপত্র ও টিভি কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া। তারা আগে যেসব বিজ্ঞাপন পেত, এখন সেগুলো পাচ্ছে ফেসবুক, গুগল, আমাজন ইত্যাদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যারা সাংবাদিকতা করে না।

এই সব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে বলা যেতে পারে অসংবাদমাধ্যম বা নন-জার্নালিস্টিক মিডিয়াম, যাদের কারণে সাংবাদিকতার প্রায় ৫০০ বছরের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতকাল সংবাদ যেখানে ছিল, মানুষের সবচেয়ে বেশি ভিড় ছিল সেইখানে। আর যেখানে সবচেয়ে বেশি মানুষের ভিড়, বিজ্ঞাপনেরও সবচেয়ে বেশি ভিড় সেখানেই। অর্থাৎ সংবাদপত্র আর টিভি স্টেশন ছাড়া বিজ্ঞাপন প্রচারের বড় কোনো মাধ্যম ছিল না। (এখানে বলা প্রয়োজন, সংবাদপত্র ও টিভি স্টেশনগুলোর সিংহভাগ আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন।)

এখন এই চিত্রটা ভীষণভাবে বদলে গেছে। এখন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ যেসব জায়গায় ভিড় করছে, সেগুলো সংবাদমাধ্যম নয়, অসংবাদমাধ্যম: গুগল, ফেসবুক, আমাজন ইত্যাদি। সিংহভাগ বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে এদের কাছে। ২০১৭ সালে সারা পৃথিবীর অনলাইন বিজ্ঞাপনের ৬১ শতাংশই পেয়েছে এই গুগল আর ফেসবুক। আমেরিকান মোট অনলাইন বিজ্ঞাপনের ৭৩ শতাংশ পেয়েছে এই দুটো প্রতিষ্ঠান। এক বছরে সারা দুনিয়ায় অনলাইন বিজ্ঞাপনের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার ৮৩ শতাংশই গেছে তাদের ভাগে।

ছাপা সংবাদপত্রের পাঠক যখন কমতে শুরু করে, আর অনলাইনের পাঠক বাড়তে থাকে, তখন আশা করা হয়েছিল যে ছাপা সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনগুলো চলে যাবে অনলাইন সংস্করণে। কিন্তু বাস্তবে তা সেই মাত্রায় ঘটেনি, যার ফলে একটি সংবাদমাধ্যমের ছাপা ও অনলাইন উভয় সংস্করণের মোট আয় বাড়তে অনেক বেশি পারত। আসলে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো প্ল্যাটফর্মেই বিজ্ঞাপন ধরে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, সেগুলোর তুলনায় গুগল-ফেসবুকে মানুষের ভিড় শত শত গুণ বেশি। গুগল আর নিউইয়র্ক টাইমসের অনলাইন বিজ্ঞাপনের আয়ের পার্থক্য লক্ষ করলে বিস্মিত হতে হবে: ২০১৬ সালে গুগল আয় করেছে মোট ৭ হাজার ৯৪০ কোটি মার্কিন ডলার, আর নিউইয়র্ক টাইমসের আয় হয়েছে মাত্র ৫৮ কোটি ৭ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার।

ফলে সাংবাদিকতার এতকালের বিজনেস মডেলটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এই মডেলে সংবাদ প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়ানোর কোনো সম্ভাবনাই কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তাই প্রশ্ন উঠেছে, পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা ও শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের সামনে যে সংকট হাজির হয়েছে, তা কি অস্তিত্বের সংকট?

অস্তিত্বের সংকটই বটে। তবে এর ফলে সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটতে চলেছে—এমন কথা কেউই বলছেন না। কারণ, এতটা নৈরাশ্যবাদী হওয়া চলে না। সাংবাদিকতা পেশার মৃত্যু ঠেকানোর পথের অন্বেষণ চলছে; নতুন বিজনেস মডেল খোঁজা হচ্ছে। এখনো নির্ভরযোগ্য কোনো মডেলের সন্ধান মেলেনি; তবে আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বিজ্ঞাপনের ওপর প্রধান নির্ভরশীলতার বিজনেস মডেলটা আর চলবে না। বিজ্ঞাপন আর কখনোই সংবাদমাধ্যমের কাছে সেইভাবে ফিরবে বলে মনে হয় না, যাতে বিজ্ঞাপনের ওপরেই বেশি নির্ভর করা যায়। সম্ভবত একটা মিশ্র আয়ের বিজনেস মডেল আসবে; সেটাতে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বেশি জোর পড়বে সংবাদের ভোক্তাদের ওপর। সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা পেশার মৃত্যু ঠেকাতে হয়তো তাদের ভূমিকাই হবে মুখ্য। কারণ, সংবাদমাধ্যম ছাড়া তাদের চলবে না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ আর যত মাধ্যম বা প্ল্যাটফর্ম আছে, সবখানের ভিড় শেষে মানুষকে, নাগরিককে, ব্যক্তিকে সত্যের দেখা পেতে দিন শেষে আস্থাভাজন সংবাদমাধ্যমের কাছেই ফিরতে হবে। সম্ভবত সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের সেই ভবিষ্যৎ ত্রাণকর্তা হবে ভোক্তা গ্রাহক, অর্থাৎ সাবস্ক্রাইবার।

গ্রাহকভিত্তিক আয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের আয়ও কিছু পরিমাণে থাকবে; সেই সঙ্গে হয়তো যুক্ত হবে অসংবাদমাধ্যমের সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগির নতুন বন্দোবস্ত। কারণ, ফেসবুক–গুগলসহ সবাই সংবাদমাধ্যমের তৈরি কনটেন্ট ব্যবহার করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এ রকম একটা বিশ্র আয়ের বিজনেস মডেল যত তাড়াতাড়ি বিকশিত হবে, সাংবাদিকতা পেশার সংকট তত দ্রুত কাটবে। নিউইয়র্ক টাইমসকে সেই পথেই এগোতে দেখা যাচ্ছে।

মশিউল আলম : প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক