ইতিহাসের দায় ও শহীদ নূর হোসেন

বুকে ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’ এবং পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন নূর হোসেন। (বাঁয়ের ছবি সংগৃহীত, ডানের ছবিটি তুলেছেন পাভেল রহমান)
বুকে ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’ এবং পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন নূর হোসেন। (বাঁয়ের ছবি সংগৃহীত, ডানের ছবিটি তুলেছেন পাভেল রহমান)
১০ নভেম্বর ছিল শহীদ নূর হোসেন দিবস। সেই দিনটিকে স্মরণ করেই এ আয়োজন


নূর হোসেন রাষ্ট্রের বা সমাজের কোনো কেউকেটা ছিলেন না। তিনি ‘শিক্ষিত’ও ছিলেন না। সম্ভবত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পেশায় ছিলেন মোটরশ্রমিক। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না তিনি। কিন্তু তিনি নিজের জীবন উৎসর্গের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মিছিলে যান নূর হোসেন। তাঁর বুকে-পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। ওই মিছিলে বাংলাদেশ সচিবালয়ের পাশে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং মাত্র ২৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ১০ নভেম্বর দিনটির গুরুত্ব আর নূর হোসেনের আত্মত্যাগের মাহাত্ম্যকে মাথায় রেখে দিনটিকে নানা নামে অভিহিত করার ক্যারিকেচার হয়েছে ঢের। অবশেষে পদ্মা-যমুনার অনেক জল সাগরে গড়ানোর পর দেশের মানুষ ও রাজনীতিবিদেরা সাব্যস্ত করেছেন, নূর হোসেন দেশ ও দশের জন্য ‘শহীদ’ হয়েছেন। সেই থেকে ১০ নভেম্বর ‘শহীদ নূর হোসেন দিবস’। আর জিরো পয়েন্ট, যেখানে নূর হোসেন নিহত হয়েছিলেন, সেই জায়গার নাম রাখা হয় নূর হোসেন চত্বর। নূর হোসেন বিষয়ে এতটুকুই আমরা জানি। জেনে তাঁকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু কেউ কেউ নূর হোসেনকে এর বাইরেও আরও আলাদা চোখ, চেতনা আর আবেগ দিয়ে দেখতে চান। কবি শামসুর রাহমান ও মতিউর রহমান রচিত ‘শহীদ নূর হোসেন’ (২০১৩) গ্রন্থটি সেই আলাদা রকম একটা চেষ্টা।

কবি শামসুর রাহমান ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান রচিত ‘শহীদ নূর হোসেন’ বইয়ের প্রচ্ছদ
কবি শামসুর রাহমান ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান রচিত ‘শহীদ নূর হোসেন’ বইয়ের প্রচ্ছদ

বলে রাখা দরকার, ‘শহীদ নূর হোসেন’ গ্রন্থটি কোনো তাৎক্ষণিক রচনা নয়। ১৯৮৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে নূর হোসেনকে উপলক্ষ করে মতিউর রহমানের ইতিহাস ভাবনা, রাজনৈতিক চেতনা, স্বদেশ ভাবনা ও আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই গ্রন্থ। গ্রন্থটি শামসুর রাহমান আর মতিউর রহমানের যৌথ রচনা। তাঁদের দুজনের যৌথ আবেগ আর রাজনৈতিক দর্শন গ্রন্থটিতে খোদিত হয়েছে। গ্রন্থনা ও পরিকল্পনা মতিউর রহমানের। নূর হোসেনকে নিয়ে শামসুর রাহমানের শেষ কবিতা ‘আলো ঝরানো ডানা’ রচিত হয়েছে ১৯৮৯ সালে। কিন্তু মতিউর রহমানের নূর হোসেন-বিষয়ক অন্বেষা শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পরও শেষ হয়নি। নূর হোসেনকে নিয়ে তিনি ২০০৫ সাল পর্যন্ত লিখেছেন, ভেবেছেন, ভেবে চলেছেন। ভেবে যে চলেছেন তার প্রমাণ, ‘শহীদ নূর হোসেন’ গ্রন্থের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে। মতিউর রহমান লক্ষ করেছেন, এই ১৮ বছরে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে নূর হোসেন-বিষয়ক আবেগ প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছেছে। বলা যায়, নূর হোসেন প্রায় ‘মরিয়া হজিয়া গিয়াছেন’। তিনি এখন কেবল ধূসর একটি স্মৃতিতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর দিনটি শুধু আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব দিবস পালনের খুপরির মধ্যে ঢুকে গেছে। কিন্তু গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের মুক্তির যে বাসনা নিয়ে নূর হোসেন আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, তা তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে জনমনে ও রাজনীতিতে খুব একটা ঝড় তুলতে পারছে না। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই মতিউর রহমান প্রকাশ করেছেন ‘শহীদ নূর হোসেন’ গ্রন্থের পরিবর্ধিত সংস্করণ। নূর হোসেনের আত্মত্যাগ এবং পরবর্তী নিষ্করুণ বাস্তবতা—এই দুইয়ের মধ্যকার শূন্যতার বোধই এই গ্রন্থের পেছনে ক্রিয়াশীল বলে মনে হয়। এই শূন্যতাজাত আকুতি ও বেদনাবোধ এই বইয়ের প্রতিটি লেখা থেকে নিংড়ে পড়েছে। আকুতি ও বেদনাটি শামসুর রাহমান ও মতিউর রহমানের যৌথ। আয়োজনটি মতিউর রহমানের।

শামসুর রাহমান আর মতিউর রহমানের যৌথ অনুভবের বিষয়টি বোঝা যাক এবার। ‘শহীদ নূর হোসেন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ১৯৮৭ সালে রচিত শামসুর রাহমানের ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ কবিতার একটি অংশ লক্ষ করা যাক:

হয়তো ভবিষ্যতে অনেকেই
তার কথা বলে দিব্যি মাতাবে শ্রোতার ভিড় আর
করবে এমন কেউ কেউ উচ্চারণ
ওর নাম, হোমরা-চোমরা তারা, যারা
তার কথা বলছে শুনলে সে আবার অকস্মাৎ
জিন্দা হয়ে পতাকার মতো হাত তুলে
জনসভা পণ্ড করে জানাবে তুমুল প্রতিবাদ,
ওদের মুখোশ-আঁটা ভণ্ড মুখে দেবে ছুড়ে থুথু, শুধু থুথু।

গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ২০০৫ সালে রচিত মতিউর রহমানের লেখা ‘শহীদ নূর হোসেনের পিতার মৃত্যুর পর কিছু কথা’ রচনাটি যেন শামসুর রাহমানের ভবিষ্যদ্বাণীরই সাম্প্রতিক প্রতিবেদন:
নূর হোসেন শহীদ হওয়ার দু-তিন বছর পর শুধু নয়, স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর প্রায় দেড় যুগ ধরে সভা-সমাবেশ অনেক হলো। হরতালও কম হলো না। কত মানুষের মৃত্যু হলো...। কিন্তু তেমন তো বড় কোনো পরিবর্তন হলো না সাধারণ মানুষের জীবনে।
একই লেখায় মতিউর রহমান নূর হোসেনের পিতার বলা সংলাপ তুলে দিয়েছেন এভাবে: ‘নূর হোসেন যা চেয়েছিল, তা তো হলো। স্বৈরাচার নিপাত হলো। এখনো দেশে এত হানাহানি, সন্ত্রাস। গণতন্ত্র তো মুক্তি পেল না।’ শামসুর রাহমানের আশঙ্কা, নূর হোসেনের বাবার আক্ষেপ আর মতিউর রহমানের বেদনাবোধই এই গ্রন্থ জন্মের আঁতুড়ঘর। দেশ ও দশ নিয়ে ভাবনার ঐক্যই রাহমান ও রহমানকে এক মলাটে আবদ্ধ করেছে বলে মনে হয়।

বলছিলাম ‘শহীদ নূর হোসেন’ গ্রন্থটি কোনো তাৎক্ষণিক রচনা নয়। এটি কবি শামসুর রাহমান আর মতিউর রহমানের দীর্ঘদিনের ভাবনা-কল্পনার ফসল। বইয়ের লেখাগুলোর সময়কাল লক্ষ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। নূর হোসেন-বিষয়ক শামসুর রাহমানের প্রথম দুটি কবিতা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ ও ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ প্রকাশিত হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে। ছাপা হয়েছিল সাপ্তাহিক একতা ও সাপ্তাহিক দেশবন্ধু পত্রিকায়। তৃতীয় কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালের ১১ নভেম্বর সাপ্তাহিক একতায়। আর মতিউর রহমানের লেখাগুলোর প্রকাশকাল ৩১ জানুয়ারি ১৯৮৮, ১১ নভেম্বর ১৯৮৮, ১৩ নভেম্বর ১৯৮৯, ১০ নভেম্বর ১৯৯৩, ১০ নভেম্বর ২০০৪ এবং ১৯ মার্চ ২০০৫। ১৯৯০ সালে শামসুর রাহমানের তিনটি কবিতা আর মতিউর রহমানের তিনটি নিবন্ধসহ ‘শহীদ নূর হোসেন’ বইটি ছোট্ট কলেবরে প্রথম প্রকাশিত হয় জ্ঞান প্রকাশনী থেকে। আবার মতিউর রহমানের আরও কিছু লেখাসহ বইটির নতুন সংস্করণ বের হয় ২০১৩ সালে। তার মানে নূর হোসেনকে নিয়ে মতিউর রহমানের চিন্তাচেতনা ক্রিয়াশীল দুই যুগের বেশি সময় ধরে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, নূর হোসেন যখন বিস্মৃতিতে পরিণত হতে চলেছেন, তখন তাঁকে নিয়ে মতিউর রহমানের এই নিরন্তর অবিচ্ছিন্ন আগ্রহের কারণ কী! এটাই এই গ্রন্থ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বলে মনে করি।

সোজাসাপটা কথা, নূর হোসেন গরিব মানুষ ছিলেন। এই গরিব মানুষের আত্মত্যাগকে মতিউর রহমান গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। এই গরিব মানুষকে কেন্দ্রে রেখে তিনি বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসটি একবার চেখে নিতে চেয়েছেন। বলা ভালো, তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে গরিব মানুষের অবদানের ইতিহাস নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তাই যদি না হবে, তিনি নূর হোসেনের আত্মত্যাগ নিয়ে বলতে গিয়ে নূর হোসেনের গরিব বেবিট্যাক্সিচালক বাবা মজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সেঁটে দেবেন কেন! নূর হোসেনের বাবার সঙ্গে দীর্ঘদিনের মেলামেশা আর আলাপচারিতায় মতিউর রহমান যা জেনেছেন তাঁর লেখায় তা উঠে এসেছে এভাবে:

‘১৯৫২ থেকে ৫৪ সালের ঢাকার বুকের রাজনৈতিক ঘটনাবলির উত্থান-পতনকে যৌবনের বিস্ময়ভরা চোখে দেখেছেন মজিবুর রহমান। মুসলিম লীগ সরকারের সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার আর নির্যাতন তাঁকে বিদ্রোহী করেছে।’ ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় নবাবপুর রোডে শেরেবাংলা ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থাশীল হয়েছেন। পল্টন ময়দানে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে ‘ও বাঙালি, ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ গানটি শুনে চোখের পানি ঝর ঝর করে পড়েছে তাঁর। কেঁদে আকুল হয়েছেন মজিবুর রহমান।

এ সময়ের পর থেকে মজিবুর রহমান জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের এবং আওয়ামী লীগের সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এভাবে পুরো ষাটের দশকে তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।

নূর হোসেনের আত্মত্যাগকে মতিউর রহমান বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখতে চাননি। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন লেখা পড়ে অন্তত তাই মনে হয়। তিনি নূর হোসেনের এই আত্মত্যাগকে দেশের জন্য গরিব মানুষদের আত্মত্যাগের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। দেখার এই ধরনটির ক্ষেত্রে শামসুর রাহমান আর মতিউর রহমানের মধ্যে একটা নিবিড় মিলই এই গ্রন্থে দুজনকে এক মলাটে বেঁধে রেখেছে।

লক্ষ করার বিষয়, শামসুর রাহমানের নূর হোসেন-বিষয়ক তিনটি কবিতার দুটিই প্রকাশিত হয়েছিল মতিউর রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক একতা পত্রিকায়। নূর হোসেনের আত্মত্যাগের প্রশ্নে দুজনের মধ্যে ভাব ও চিন্তার আদান-প্রদানের বিষয়টি সহজেই বোঝা যায় যখন শামসুর রাহমান কবিতায় বলেন:

ওর বর্ষীয়ান পিতা, যিনি বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে
পা রেখেছিলেন ঢাকার মাটিতে,
তিনি ‘নূর নূর’ বলে ডাকেন, কিন্তু এক থমথমে নিস্তব্ধতা ছাড়া
তিনি কোনো সাড়া পান না। তিনি এই পাথুরে
শহরের উপেক্ষিত
দরিদ্রমণ্ডলীর একজন, অথচ তাঁর মাথায়
জ্বলজ্বলে সোনার মুকুট, যা পরিয়ে দিয়েছে
তাঁর হৃদয়ের নূর। সেই মুকুটের দিকে তাকানোর
সময় কোথায় এই নষ্ট শহরের?

শামসুর রাহমান নূর হোসেনের বাবাকে ১৯৫২ সালের সঙ্গে সেঁটে দিতেই বলেছেন, ‘ওর পিতা, যিনি বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে/ পা রেখেছিলেন ঢাকার মাটিতে’। আর মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘১৯৫২ সালে যেদিন মজিবুর রহমান তাঁর নিজ গ্রাম ঝাটিবুনিয়া থেকে লঞ্চে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছান, সেদিন ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি।’ ভাবা যেতেই পারে নূর হোসেন, তাঁর পরিবার ও সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে শামসুর রাহমান ও মতিউর রহমানের মধ্যে বিভিন্ন সময় কথাবার্তা হয়েছে। অন্তত নূর হোসেনের বাবার ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আসার তথ্যটি শামসুর রাহমান মতিউর রহমানের কাছ থেকেই জেনেছেন বলে অনুমান করি। শুধু তথ্য নয়, ভাবের মিল দুজন লেখকের মধ্যে বেশ।

দুজনই নূর হোসেনকে শ্রেণির দিক থেকে একটি বর্গের মধ্যে স্থাপন করে দেখেছেন। নূর হোসেনের বাবাকে শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘উপেক্ষিত দরিদ্রমণ্ডলীর একজন’। এই ‘উপেক্ষিত দরিদ্রমণ্ডলীর একজন’-এর সন্তান নূর হোসেনের সংগ্রামী আর প্রতিবাদী হাতেই রাহমান বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে দেখে কবিতায় বলে উঠেছেন, ‘কব্জিতে তার দপদপ করে ভবিষ্যৎ’। নিঃসন্দেহে এই ভবিষ্যৎ নূর হোসেনের ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। আদতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবল নয়, অতীতও মূলত এই শ্রেণির আত্মত্যাগেই নির্মিত হয়েছিল মনে করেই নূর হোসেনের বাবার অভিযাত্রা যে ভাষা আন্দোলনের দিন থেকে শুরু হয়েছে, সে কথা রাহমান ও রহমান কেউই বলতে ভোলেননি। শামসুর রাহমান এ বিষয়ে খুবই সচেতন ছিলেন যে, বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত মজিবুর রহমান, নূর হোসেনদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। এ কারণে রাহমান কোনো রকম ভণিতা ছাড়া উচ্চারণ করতে পেরেছেন এই চরণ, ‘শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা/ নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়/ ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ/ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে’...। রাহমান খুব সচেতনভাবে নূর হোসেনকে ‘হোমরাচোমরা’দের বিপরীতে স্থাপন করেছেন তাঁর ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ কবিতায়। একই তৎপরতা আর চেতনা আমরা লক্ষ করি এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত মতিউর রহমানের লেখা বিভিন্ন নিবন্ধে। লক্ষ করা যাক মতিউর রহমান শুরুতে কীভাবে নূর হোসেনদের শ্রেণি নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন:

এঁকেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ‘শহীদ নূর হোসেন’ বইয়ে
এঁকেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ‘শহীদ নূর হোসেন’ বইয়ে

মজিবুর রহমানের পরিবারের কর্মক্ষম সব সদস্যই মেহনত করেন, উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বলতে গেলে, বাংলাদেশের লাখো-কোটি শ্রমজীবী মানুষের অন্তর্ভুক্ত সত্যিকার অর্থেই একটি প্রতিনিধিত্বশীল পরিবার-গোষ্ঠী তাঁরা। মজিবুর রহমান সেই কোন যৌবনকালে ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় এসেছিলেন বরিশালের (বর্তমানে পিরোজপুর) মঠবাড়িয়ার ঝাটিবুনিয়া গ্রাম থেকে। ঢাকাজীবনের শুরুতে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে মসলা পেষার কাজ করেছেন। পরে সেখানেই পেয়েছেন সিক বয় ডিউটির কাজ। একই হোস্টেলে বাবুর্চির কাজ করেছেন অনেক দিন। ওই কাজ থেকে ছাঁটাই হওয়ার পর রিকশা চালিয়েছেন আট বছর।

এই পরিবারেরই সন্তান নূর হোসেন। পেশায় ছিলেন মোটর ড্রাইভার। মতিউর রহমান এখানেই ফোকাস করেছেন। নূর হোসেনের শ্রমজীবী বাবা মজিবুর রহমানকে ইতিহাসের পটে রেখে, নূর হোসেনকে কেন্দ্রে রেখে মতিউর রহমান ছুট দিয়েছেন ভবিষ্যতের বাংলাদেশের দিকে। প্রান্তিক শ্রেণির আত্মত্যাগের সঙ্গে তিনি খুব সচেতনভাবে যুক্ত করেছেন সংস্কৃতিকর্মী ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে। শোনা যাক মতিউর রহমানের নিজের ভাষায়:

এভাবেই বিগত তিন-চার দশকের শত সংগ্রামে পোড়খাওয়া এক প্রবীণ প্রজন্ম বাংলাদেশের শহরে, গ্রামে, শ্রমিক বস্তিতে, খেতমজুরের আস্তানায় গড়ে উঠেছে। সারা দেশে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদেরই সৃষ্ট ভিত্তিভূমিতে এই কয়েক দশকের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নূর হোসেনের মতো সাহসী এবং আত্মত্যাগে উন্মুখ এক নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এভাবেই মেহনতি মানুষের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ গভীরভাবে আলোড়িত ও অনুপ্রাণিত করছে শামসুর রাহমানের মতো আরও অনেক প্রবীণ-নবীন কবি আর চিত্রশিল্পী, সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, নাট্য ও কণ্ঠশিল্পী এবং নানা পেশার মানুষকে। এসব ছোট-বড়¯স্রোতধারা মিলেমিশে এক উত্তাল তরঙ্গমালা সৃষ্টির আয়োজন চলছে বাংলাদেশে, প্রকাশ্যে এবং অলক্ষ্যে।

সবশেষে বলব, ‘শহীদ নূর হোসেন’ বইটিকে কেবল নূর হোসেনের এলিজি হিসেবে পড়া যায় না। বইটির গভীর তলদেশ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের ফল্গুধারা বয়ে চলেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূত-ভবিষ্যতের মানচিত্রের উঁকিঝুঁকিও বেশ বোঝা যায় বইটিতে। পাঠকের মনকে আর্দ্র করে রাখে এই বইয়ের দুজন লেখকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর নিঃশর্ত ভালোবাসা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শ্রীনগর সরকারি কলেজ, মুন্সিগঞ্জ।