সুন্দরবন বাঁচালে আমরা বাঁচি

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

যুগ যুগ ধরে সুন্দরবন বাংলাদেশকে কালাপাহাড়ের মতো আগলে রেখেছে। সুন্দরবনের কারণে আইলা-সিডর আরও প্রলয়ংকরী হতে পারেনি। প্রায় ৬ দশমিক ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরী-গেওয়াসহ নানা বৃক্ষের মজবুত বেষ্টনী আর অসংখ্য নদীনালা বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের প্রাণ ও সম্পদ রক্ষা করে আসছে। এবারও ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বাংলাদেশের লোকালয়ে আঘাত হানার আগেই তার প্রবল শক্তি হ্রাস করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন।

সুন্দরবনের এই মাতৃসুলভ আচরণ আবহাওয়া অধিদপ্তরসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট মহল থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন শুধু যে ঝড়ের সময় উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় ‘কালাপাহাড়ের’ ভূমিকা পালন করে তা-ই না, সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গোটা বাংলাদেশকেই সে বাঁচিয়ে রেখেছে নানাভাবে। সুন্দরবনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

সুন্দরবনকে নিয়ে সুন্দর আর মানবিক বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। সাংবাদিকদের সাক্ষী রেখেই মন্ত্রী বলেছেন, ‘সুন্দরবনকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন, কারণ সুন্দরবন বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করছে। সুন্দরবনের প্রতি কেউ যেন অযত্ন-অবহেলা করতে না পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে উদ্যোগ নিতে বলব। আমি আপনাদের (সাংবাদিকদের) রেফারেন্স দিয়েই বলব, সুন্দরবনের যেন আরও যত্ন নেওয়া হয়, নতুন নতুন গাছ লাগিয়ে বনকে শক্তিশালী করা হয়।’ মন্ত্রীর এ রকম সাহসী বক্তব্যের পর শুধু যে খুশিরামরা (যাঁরা সব সময় কারণে-অকারণে হাসিখুশি থাকতে চান) খুশি হয়েছেন তা-ই নয়, বরং আন্তরিকভাবেই সুন্দরবন বাঁচাতে চান, তাঁদেরও খুশি হওয়ার কথা।

মন্ত্রী নিশ্চয় জানেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৫(১) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের বাইরের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)বা লক্ষ্মণরেখা হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনের এই প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় পরিবেশদূষণকারী শিল্পকারখানা স্থাপনে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করা একটি নীতিবহির্ভূত অন্যায় কাজ।

গত ২৯ জুন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদ লুৎফুননেসা খান (সংরক্ষিত আসন-৪৮) এবং মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ মমতাজ বেগমের প্রশ্নের জবাবে বন ও পরিবেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী স্বীকার করেছিলেন, কথিত আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা রিজার্ভ ফরেস্টের ৬ কিলোমিটারের মধ্যেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সংকটাপন্ন এলাকায় চিহ্নিত বায়ুদূষণকারী পাঁচটি সিমেন্ট কারখানাকে (মেঘনা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, বসুন্ধরা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, মোংলা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, দুবাই-বাংলা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড এবং হোলসিম (বাংলাদেশ) লিমিটেড) পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

বোধ হয় সেদিন সংসদে সাভারের সাংসদ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। না থাকলেও তিনি তাঁর মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় বন্ধু্ দুর্যোগের হাত থেকে দেশকে রক্ষাকারী সবচেয়ে বড় ‘প্রতিষ্ঠান’ সুন্দরবন ধ্বংসের এসব পাঁয়তারা সম্পর্কে নিশ্চয় অবহিত আছেন। সেদিন বনমন্ত্রী সংসদকে এই বলে অভয় দিয়েছিলেন যে আইনের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ‘লক্ষ্মণরেখা’র ভেতর যেসব প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের কারণে যাতে পরিবেশদূষণ না হয়, সে জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর এসব শিল্পকারখানা নিয়মিত পরিবীক্ষণ করছে এবং উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, এসব ছেলেভুলানো কথায় সুন্দরবন রক্ষা হবে না।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উদ্বেগ ও পরামর্শ উপেক্ষা করে সুন্দরবনের নাকের ডগায় কয়লাভিত্তিক রামপাল, তালতলি, কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পায়ন কাজ কেউ রুখতে পারেনি। জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি কর্তৃক সুন্দরবনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যে’র তালিকায় অন্তর্ভুক্তির আশঙ্কা তৈরি হলেও ‘নিজের পায়ে কুড়াল মারা’র মতো সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উপেক্ষা করেই ‘সুন্দরবনের বিনিময়ে উন্নয়নে’র এই প্রক্রিয়া এখনো বন্ধ হয়নি।

এই একগুঁয়েমি উন্নয়নধারা শুধু যে আমাদের দুর্যোগের ত্রাতা সুন্দরবনকে শেষ করে দেবে তা-ই নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের অঙ্গীকারকে ফাঁকা বুলিতে পরিণত করবে। আর দেশ হবে হাসির পাত্র।

২০১৭ সালের ২৯ জুন বিশ্ব বাঘ দিবসের আলোচনায় যোগ দিয়ে তখনকার পরিবেশ ও বনমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, ‘সুন্দরবন না থাকলে বাগেরহাট ও খুলনাই নয়, গোপালগঞ্জও থাকবে না। বাঘ রক্ষার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিক।’ সেই মন্ত্রী কী কারণে বাগেরহাট ও খুলনার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে শুধু গোপালগঞ্জের নাম নিয়েছিলেন, তা তিনিই ভালো জানবেন। তবে এটা ঠিক, সুন্দরবনের অস্তিত্বের সঙ্গে দেশের একটা কি তিনটা জেলার অস্তিত্ব নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকা না-থাকার প্রশ্ন জড়িত।

যে সুন্দরবন নিজেকে নিঃস্ব করে হলেও আমাদের সুরক্ষা দিতে কোনো কার্পণ্য করে না, সে সুন্দরবনের সঙ্গে আমরা কি ন্যায্য আচরণ করেছি, করছি? অসুস্থ মাকে রেলস্টেশনে কি রাস্তার পাশে ফেলে যাওয়া দায়িত্বহীন সন্তানের সঙ্গে আমাদের আচরণের কি কোনো পার্থক্য আছে? কথায় কথায় সুন্দরবনের ওপর আমাদের নিরঙ্কুশ আস্থা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে হাতে-কলমে, কাজে ও পরিকল্পনায়।

আশা করি ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান তাঁর বক্তব্যে স্থির থেকে গভীর মমতায় সুন্দরবন সুরক্ষায় এক চালিকাশক্তির দায়িত্ব পালন করবেন। দলমত, পথ-পাথেয়র বিভাজন ভুলে আমাদেরও উচিত হবে তাকে তথ্য-উপাত্ত আর সমর্থন দিয়ে সাহায্য করা।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]