চীনা প্রযুক্তিকে ধসাতে 'ডিক চেনি তত্ত্ব'

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিকৃষ্ট এবং সম্ভবত সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী পররাষ্ট্রনীতিভিত্তিক সিদ্ধান্ত ছিল ২০০৩ সালে ইরাকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে—এমন মিথ্যা দাবি করে এই যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে কখনো মার্কিন প্রশাসনে বিশদ আলোচনা হয়নি। কারণ, এই ধরনের খোঁড়া যুক্তিকে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রান্ত নীতির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানো হচ্ছে।

ইরাকে হামলা চালানোর আগে তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি বলেছিলেন, সাদ্দামের হাতে এই গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার আশঙ্কা যদি ১ শতাংশও থাকে, তাহলে সেটিকেই আমাদের শতভাগ আশঙ্কা হিসেবে ধরে নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা এখনো সেই চেনি তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের পেছনে লাগছে। এখন তারা চীনের প্রযুক্তি খাতের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে গিয়ে সেই পুরোনো ডিক চেনি তত্ত্ব ব্যবহার করছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখন বলছে, চীনের প্রযুক্তি নিরাপদ কি না, সে বিষয়ে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র শতভাগ নিশ্চিত হতে পারছে না, সেহেতু চীনা প্রযুক্তিকে নিশ্চিত বিপজ্জনক হিসেবে ধরে নিতে হবে এবং সেগুলোকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত সব সময় বিকল্প পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। কথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে পড়ার ১ শতাংশ ঝুঁকিকে ইরাকে হামলার যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির ৯৯ শতাংশ ঝুঁকির কথা তারা চেপে গিয়েছিল। ১ শতাংশ ঝুঁকির ওপর জোর দিয়ে চেনি এবং অন্যরা গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বব্যবস্থাকে অস্থির করে তুলেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা এখন আবার সেই একই কাজ শুরু করেছেন। তাঁরা এখন চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ছোটখাটো এবং নগণ্য ভুলত্রুটিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ও অতিরঞ্জিত করে বিরাট করে দেখানোর মিশন হাতে নিয়েছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আক্রমণের শিকার হচ্ছে ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড কোম্পানি হুয়াওয়ি। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার বাজার থেকে কোম্পানিটির সব বের করে দিচ্ছে এবং সারা বিশ্বের বাজার থেকে তাকে তাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। ইরাকের মতো চীনকেও সারা বিশ্বের কাছে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হুয়াওয়ের প্রযুক্তি এগিয়ে চলা এবং তাদের সেবা দেওয়ার ধরন সম্পর্কে আমি দীর্ঘদিন খোঁজখবর রেখেছি। সেখান থেকেই আমি বিশ্বাস করি, তাদের ফাইভ–জি এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তি দারিদ্র্যবিমোচন এবং অন্যান্য এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ভূমিকা রাখছে।

আমি অন্য টেলিকম কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি এবং এসডিজি লক্ষ্য পূরণে তাদের উৎসাহিত করে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বারবার বলছে, হুয়াওয়ে ফাইভ-জি ইকুইপমেন্ট বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি,হুয়াওয়ে সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারে একটি ‘ব্যাকডোর’ সংযুক্ত আছে, যার মাধ্যমে চীন গোটা বিশ্বে নজরদারির তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, হুয়াওয়ে ফাইভ-জি ইকুইপমেন্ট দামে কম এবং মানে তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত। এই কোম্পানি অন্যদের চেয়ে অনেকগুলো ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ফাইভ-জির প্রসার সবচেয়ে বেশি দরকার। এ ক্ষেত্রে হুয়াওয়েকে বাজার থেকে বের করে দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত হবে।

মজার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়ে যন্ত্রাংশে ‘ব্যাকডোর’ বসানো থাকার কথা বললেও তার সমর্থনে কোনো প্রমাণ দিচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের পর যুক্তরাজ্য এ বিষয়ে তদন্ত করেছে। কিন্তু তারা কোনো ‘ব্যাকডোর’ খুঁজে পায়নি। জার্মানিতেও হুয়াওয়ে নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিকে বলেছে, তারা যদি তাদের বাজার থেকে হুয়াওয়েকে বের করে না দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির সঙ্গে গোয়েন্দা সহযোগিতা সীমিত করে ফেলবে।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে সম্প্রতি জার্মানির গোয়েন্দাপ্রধান চেনি তত্ত্ব প্রয়োগ করে বলেছেন, ‘যে কোম্পানির ওপর আস্থা রাখা যায় না, তাদের জন্য অবকাঠামো বরাদ্দ দেওয়া যায় না।’ হুয়াওয়ের ওপর কেন আস্থা রাখা যায় না, সে ব্যাপারে তিনি কোনো কথা বলেননি। তবে জার্মানির চ্যান্সেলর অাঙ্গেলা ম্যার্কেল পর্দার আড়ালে থেকে হুয়াওয়েকে জার্মানির মার্কেটে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ট্রাম্প প্রশাসন যদি বাণিজ্যযুদ্ধের নামে প্রযুক্তিজগৎকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে, তাহলে সেই দুই ভাগের সংঘাত বৈশ্বিক প্রযুক্তি ব্যবস্থাকে কী ভয়ানক অবস্থায় নিয়ে যাবে, তা সহজেই বোঝা যায়। আমেরিকাই প্রথম মুক্তবাজারের ধারণা চালু করে মার্কিন প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছিল। সেই আমেরিকাই এখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর প্রযুক্তি প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে শুধু ওই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশটিই নয়, গোটা বিশ্ব হুমকির মুখে পড়ছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি. স্যাক্স: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বিষয়ের অধ্যাপক