মিয়ানমারের গণহত্যার বিচার

রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে ৫৭ জাতি ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে একটি ভিন্নমাত্রার কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে। এত দিন যাঁরা নীরব ছিলেন, শুধুই দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে প্রত্যাবাসন–সংকটের সুরাহা করতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, তাঁদের নতুন করে ভাবতে হবে। এটা এখন পরিষ্কার যে, বিশেষ করে আঞ্চলিক ও পরাশক্তিগুলো অব্যাহতভাবে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমাধানের যে তাগাদা দিয়ে আসছিল, তা অকার্যকর। তাদের এ ধরনের অবস্থান কতটা সমীচীন ছিল, সেটাও এক বড় প্রশ্ন। এসবের মাধ্যমে কার্যত মিয়ানমারের দায়মুক্তির মেয়াদকেই দীর্ঘায়িত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু এখন আশা করা যায়, তারা আর আগের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। গণহত্যার সংজ্ঞা নিয়ে কেউ অহেতুক বিতর্ক তুলতে পারে, কিন্তু সেখানে যে মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে বিষয়ে বিশ্বের কোনো সচেতন মহলে সংশয় নেই।

গাম্বিয়ার সমর্থনে কানাডা এবং ১০টি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার পক্ষে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আশা করব, ওআইসির শক্তিশালী দেশগুলো তাদের নীরবতা ও দ্ব্যর্থক কৌশল পরিহার করে সোজাসাপ্টা এ বিষয়ে মুখ খুলবে। অটোয়াকে অনুসরণ করে কানাডার পশ্চিমা ঐতিহ্যগত মিত্ররা দ্রুত তাদের মতামত ব্যক্ত করবে। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বিবৃতি যথার্থ যে তারা এ বিষয়ে ‘সমমনা দেশগুলোর’ সঙ্গে দ্রুত বিচারের জন্য কাজ করবে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সঠিকভাবেই সোমবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর সন্নিহিত দেশগুলোর উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। গাম্বিয়ার উদ্যোগে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ছাপ আছে। কিন্তু বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় দ্বিপক্ষীয়ভাবে সংকট নিরসনে মনোযোগী ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের নমনীয় মনোভাবকে দুর্বলতা ভেবেছে। তারা প্রত্যাবাসনের নামে কালক্ষেপণের কূটকৌশল অবলম্বন করেছিল।

মিয়ানমারে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং বাক্‌স্বাধীনতার ওপর খড়্গ থাকার বিষয়টি আমাদের মনে রাখা জরুরি। এমনটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে দেশটিতে মানবতা মরে গেছে। দীর্ঘ সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর চাপা থাকার কারণে সেখানকার জনমত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া কঠিন। নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গারা যে একেবারেই বিচ্ছিন্ন, তা নয়। দেশটির আরও কিছু জাতিগোষ্ঠী আছে, যারা শাসকদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের অসহায় শিকার এবং তারাও উৎপীড়কদের বিচার চায়। পরিবেশ তৈরি হলে মিয়ানমারের শান্তিকামী মানুষও গণহত্যার মতো অপরাধের বিচার চাইবে। তারা বুঝতে পারবে গণহত্যাকারীরা মানবতার শত্রু, এর সঙ্গে দেশপ্রেম ও জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশকে তাই গণহত্যার বিচারপ্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সতর্ক ও সোচ্চার হতে হবে। বিচারের সমর্থনে সম্ভব সব রকম রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

আমরা আশা করব, বাংলাদেশের মিত্রদেশগুলোর মধ্যে বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও ভারত গাম্বিয়ার এ উদ্যোগের পাশে দাঁড়াবে। গাম্বিয়ার এ উদ্যোগের পেছনে ওআইসির থাকাটা যেন শুধু লোকদেখানো নয়, সেটা সংস্থাটিকে স্পষ্ট করতে হবে। অতীতে বহু ক্ষেত্রে ওআইসির দায়সারা সমর্থন আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু এটি এমন একটি উদ্যোগ, যা তাদের সংগঠনের সনদে বর্ণিত মৌলিক করণীয়কে নির্দেশ করে। ওআইসির বেশ কিছু দেশের সঙ্গে ভারত, চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত এবং দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই ওআইসির তরফে যেমন সর্বাত্মক কূটনীতি প্রত্যাশিত, তেমনি জাতিসংঘসহ সরকারি ও বেসরকারি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংঘগুলোরও উচিত বিচারপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে ও কার্যকর করতে অবদান রাখা।