সুদমুক্ত টাকার গাড়ির অপব্যবহার বন্ধ করুন

সরকারের প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য এককালীন ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ পান। কিস্তিতে শোধ করতে হয় ঋণের টাকা। অবশ্য প্রতিবছর অবচয় হিসেবে ৮ শতাংশ টাকা আসল থেকে বাদ যায়। তা ছাড়া গাড়ির জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ভাতা পান ৫০ হাজার টাকা। এ প্রাধিকার সীমিত ছিল যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব পদধারী কর্মকর্তাদের জন্য। বছর দুই আগে সরকার তা প্রসারিত করেছে উপসচিব পর্যায় পর্যন্ত। এখন অভিযোগ আসছে, সরকারের এ উদার নীতির অপব্যবহার সম্পর্কে। এ-সংক্রান্ত বিধিবিধান প্রণয়নের সময় আশা করা হয়েছিল, এতে পরিবহন পুল ক্রমান্বয়ে চাপমুক্ত হবে। অন্তত এ ক্ষেত্রে সরকারি জনবল কম লাগবে। বাজেট বরাদ্দ ধীরে ধীরে কমবে। কিন্তু কোনোটিই হয়নি। নির্ধারিত পদসংখ্যার অনেক বেশি কর্মকর্তাকে উচ্চতর পদে পদোন্নতি প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। 

অন্যদিকে সুদমুক্ত টাকায় কেনা গাড়ি রেখে অন্য সরকারি গাড়িতে বেশ কিছু কর্মকর্তা চলাচল করছেন। কেউবা সার্বক্ষণিক ব্যবহার করছেন তাঁদের অধীন সংস্থার গাড়ি। এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একাধিকবার তথ্যভিত্তিক খবর হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রেষণ, মাঠ প্রশাসন বা প্রকল্পে কর্মরত কোনো কর্মকর্তার জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ির ব্যবস্থা থাকলে তিনি সুদমুক্ত টাকায় কেনা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অর্ধেক, অর্থাৎ ২৫ হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু বেশ কিছু কর্মকর্তা সে নিয়মও মানছেন না। গাড়ি পরিচালনা ব্যয় পুরোটাই তুলে নেন। সুদমুক্ত টাকায় কেনা গাড়িটি কিছু ক্ষেত্রে কেবলই পারিবারিক কাজে ব্যবহার করা হয়। যদিও বিরল দু-একটি ক্ষেত্রে ভাড়ায় খাটানোর অভিযোগও রয়েছে। অতিসম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিকের খবর অনুযায়ী,
এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০০ কর্মকর্তাকে সুদমুক্ত সুবিধায় গাড়ি কেনার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটাকে বিশেষ অভিহিত করা যায় এ বিবেচনায় যে ব্যাংক বা অন্যান্য সংস্থা তাদের কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার ঋণ দিলেও রেয়াতি হারে কিছু সুদ দিতে হয়। আর ঋণ ফেরতে মূল টাকা থেকে প্রতিবছর অবচয় বাদ দেওয়ার বিধান সম্ভবত বিরল। 

যাহোক, সরকার তার কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দিতে এ বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। প্রত্যাশা ছিল সরকারি কাজে গতি আসবে। বেতন-ভাতাও বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। বাড়ি করতে রেয়াতি সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে। এগুলো নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি করে না, বরং দেশের মধ্যবিত্ত খাত প্রসারের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বলেই মনে করা হয়। তবে স্বাভাবিকভাবে আশা করা হয়েছিল, এর ফলে ঘুষ-দুর্নীতি হ্রাস পাবে। তা যে পায়নি, সেটা কিছুদিন আগেই বলেছেন সরকারপ্রধান স্বয়ং। আর শুধু গাড়িসুবিধার এ অপব্যবহারকে বিবেচনায় নিলে এটাকেও দুর্নীতি বলতে হবে। 

সৌভাগ্যের কথা, এ-সংক্রান্ত খবরাদি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মকর্তাদের এ অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে। আর সে আদেশে সুদমুক্ত টাকায় কেনা গাড়ি রেখে বিশেষ ব্যতিক্রম ব্যতীত সরকারি গাড়ি ব্যবহারকে অসদাচরণ ও দুর্নীতি বলে করা হয়েছে চিহ্নিত। আদেশটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের। এটাও যথার্থ। কেননা, তাঁরাই প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। পাশাপাশি প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাও। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের কেউ কেউ এ ধরনের বেআইনি কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এমন অভিযোগও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কিছুটা নজর দিতে পারে। অবশ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যখন আদেশটি জারি করেছে, এটার সঠিক বাস্তবায়ন তদারক করা তাদেরই কাজ। তাদের বিধিগত কর্তৃত্ব ও সামর্থ্য রয়েছে এসব অনিয়ম দেখাশোনা ও প্রতিকারের। ২০১১ সাল থেকে চালু হওয়া এ কর্মসূচির আওতায় যাঁরা সরকারের ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের বেশ কিছুসংখ্যক গেছেন অবসরে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগভিত্তিক তালিকা করতে হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে সাপ্তাহিক প্রতিবেদন নিয়ে সেগুলো পর্যালোচনার ব্যবস্থা করা যায়। আর যাঁরা বিশেষ কোনো পদের সুবাদে পূর্ণকালীন গাড়িসুবিধা পাচ্ছেন, তাঁরা ঋণের টাকায় কেনা গাড়ির বিপরীতে পুরো পরিচালনা ব্যয় গ্রহণ করে থাকলে আদায়ের ব্যবস্থা করা দরকার। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসদাচরণ ও দুর্নীতির জন্য বিভাগীয় মামলাও হতে পারে। অতিদ্রুত দু-একটি ক্ষেত্রে কিছুটা কঠোর পদক্ষেপ নিলে এ ধরনের কর্মকর্তারা নিজে থেকে সতর্ক হয়ে যাবেন। সরকারি সুবিধাদি যৌক্তিক নিয়মে সবাই ভোগ করুন। সম্ভব হলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও প্রসারিত করার দাবিও জানিয়ে যেতে পারেন। 

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে এসব কর্মকর্তার গাড়িতে সচিবালয়ে প্রবেশের নিরাপত্তা স্টিকার দেওয়া থাকে। ঋণের টাকায় কেনা গাড়িতেও তা থাকারই কথা। এ স্টিকার নিয়ে গাড়িটি কোনো ধরনের বাণিজ্যিক ব্যবহারে থাকলে ব্যবহারকারী সচিবালয়ে ঢুকে পড়তে পারেন। এতে বিঘ্নিত হতে পারে সচিবালয়ের নিরাপত্তা। যত স্বল্পই হোক, এ ধরনের উদ্দেশ্যে যেসব গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের প্রতিপক্ষ নন, তাঁরা জনগণের মধ্য থেকেই এসেছেন। তাঁরা দুঃখ-দৈন্যের মধ্যে দিন কাটান, এমনটা কেউ চায় না। আবার এটাও চায় না, সরকারের দেওয়া সুবিধাদির অপব্যবহার হোক। এ সম্পদ করদাতা জনগণের। সুতরাং এর অপব্যবহারে তাদের ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে গণমাধ্যমে। সাম্প্রতিক কালে কিন্তু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। তদারককারী কর্মকর্তাদের অমনোযোগ কিংবা দ্বিধা বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছে। তবে এটা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না, এটাও নয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশটি সময়োচিত, দৃঢ় ও যথার্থ। তারা এটা প্রতিপালন করাতেও সক্ষম না হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারের বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। এ ব্যাপারে ব্যত্যয় অগ্রহণযোগ্য। বলা হয়, এ প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সমপর্যায়ভুক্ত আরও অনেকে এ ধরনের গাড়ি ঋণের সুবিধা পান না। হতে পারে। সরকার যাঁদের উপযুক্ত মনে করেছে, তাঁরাই রয়েছেন প্রাধিকার তালিকায়। সুবিধা পাচ্ছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে তাঁরা যে সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল, এ ছাপ রাখার প্রয়োজনও পড়েছে। ভাবমূর্তি সংকটে ব্যবস্থাটির মূলে হাত পড়ার আশঙ্কা থাকে। 

মাত্র এক দশক আগেও সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন, ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি বিবেচনায় রীতিমতো দীনহীন জীবন যাপন করতে হতো। তখন থেকেই এসব সুবিধার দাবি ছিল। পরবর্তী সময়ে সরকার ২০০৯ এবং ২০১৫–তে দুটো আকর্ষণীয় বেতন স্কেল দেয়। বৃদ্ধি করে অন্যান্য সুবিধা। এর একটি কিন্তু বিনা সুদে গাড়ি ও প্রাসঙ্গিক সুবিধা। সে গাড়িটি শুধু বিনা সুদে নয়, এর আসলের একটা বড় অংশ দিতে হবে না অবচয় বাদ দেওয়ার ফলে। পরিচালনা ভাতাও আকর্ষণীয়। সার্বক্ষণিক গাড়ি থাকা কর্মকর্তাদের জন্যও রাখা হয়েছে আকর্ষণীয় সুযোগ। প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তালিকাও এক ধাপ নামানোর ফলে প্রসারিত হয়েছে। এসব ব্যবস্থা নেওয়ার আগে সরকারি চাকরি অনেকটা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল। ইদানীং ব্যাপারটা বিপরীতমুখী হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা এসব ব্যবস্থার সুবিধাভোগী, তাঁদের জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ কিছু ক্ষেত্রেই তা ঘটছে না বলে অভিযোগ আসে হামেশাই। আবার অনেকেই নজরকাড়া কাজকর্ম করে আলোকিত হচ্ছেন। 

গণমাধ্যম কিন্তু ভালো কাজগুলোও প্রায়ই সামনে নিয়ে আসে। ঠিক তারা মন্দ কাজের সমালোচনাও করে স্বাভাবিকভাবেই। জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র যে সুবিধাদি তার কর্মচারীদের দিয়ে থাকে, এর যথাযথ ব্যবহার হোক, এমনটাই সবাই চান। ঠিক তেমনি সার্বক্ষণিক গাড়িসুবিধা-সংক্রান্ত বিধিবিধানের যাঁর যেটুকু প্রাপ্য, তা তিনি নেবেন। কিন্তু বিরত থাকতে হবে এর যেকোনো ধরনের অপব্যবহার থেকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত সময়োচিত নির্দেশিকাটি কঠোরভাবে অনুশীলন করা হোক, এমন দাবি সংগত। 

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব