অস্থির ক্যাম্পাসের দায় কার?

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলো জরাগ্রস্ত। দুনিয়ায় তার স্বীকৃতি কতখানি, সে প্রশ্নও জোরদার হয়ে উঠছে। হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা মেলে না। আত্মপ্রতারকেরা বলছেন, তথ্য আপডেট না করায় নাকি এ বিপত্তি। বেকুব কাকে বলে? তথ্য হালনাগাদ করে না কেন, তার জবাবদিহি নেই, শুধু শুধু লোক হাসানো।

দেশের পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে ফারাক করা কঠিন। কোনোটিই ঠিকঠাক চলছে না। কার দায় বেশি, সে প্রশ্নও বড় হয়ে উঠছে ক্রমেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় পুরোটাই সরকারের। সেখানে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগে দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছু ভন্ডুল করে দিচ্ছে।

আনুগত্য যদি যোগ্যতা ও সততা দিয়ে বিচার করা হতো, তাহলে এমন লেজেগোবরে অবস্থা হতো না। কিন্তু সরকার চায় নিঃশর্ত আনুগত্য। আইন সেখানে অবান্তর। আর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারে কেবল দুর্বৃত্তরাই। পাপ যেমন আরও পাপ ডেকে আনে, দুর্বৃত্ত প্রশাসন তেমনি গোটা প্রশাসনযন্ত্রকেই দুর্বৃত্তায়নের ঘেরাটোপে বাঁধে। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন দীর্ঘ পাঁচ দশকে কোনো সুফল দেয়নি। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অরডিন্যান্স দেশের চারটি সর্বজন (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিতেই উত্তম প্রশাসন উপহার দিতে পারেনি। গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তিকে পাশ কাটিয়ে তা সর্বনাশের শেষ কিনারে নিয়ে ফেলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ গবেষণা। তার মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়। জ্ঞান সৃষ্টির প্রথম শর্ত উদার ও মুক্ত পরিবেশ। চিন্তা ও মতপ্রকাশের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ছাড়া কখনোই তা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত বোলনা ঘোষণা তা-ই বলে। কিন্তু পরাধীন যুগে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেটুকু মুক্তচিন্তাচর্চার সুযোগ ছিল, এখন তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।

শুধু গবেষণা ও শিক্ষাদান নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ সুনাগরিক গড়ে তোলা। আগামী নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। স্বাধীন ছাত্র সংসদ এর সেরা নিদান। তিন দশক ধরে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অচিন্তনীয়। সরকারি দলের পেটুয়া ছাত্রসংগঠনের মাস্তানি সেখানে এত প্রবল যে, ভিন্নমতের কারও ক্যানটিনে ঢোকার অধিকারটুকুও নেই! রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া তো হনুজ দূর অস্ত। এই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বে-লাজ সমর্থনে বেড়ে ওঠে, দাপট দেখায়।

ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, বেগম রোকেয়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনি কল্পনাকেও হার মানায়। বরিশাল বা গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লাঠিয়াল হয়ে উঠেছিলেন অপরাজনীতির মদদেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যুবলীগের সভাপতি পদের জন্য লালায়িত। সে কথা টিভি টক শোতে লাইভে বলতে লজ্জা করেনি তাঁর। পরেও কোনো দুঃখবোধ করেছেন, এমন খবর নেই। বুয়েট তো গোটা দেশের কলজে ছিঁড়ে দিয়েছে। র‍্যাগিংয়ের নামে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই উপহাস করছে। আবরার প্রাণ দিয়ে স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে গেছেন। কিন্তু তাতে সত্যিই কোনো শিক্ষা নিয়েছে কেউ?

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানেও মুক্তচিন্তা চর্চার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেমন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি মিলেছে, তার সঙ্গে যুক্ত অভাবনীয় শিক্ষাবাণিজ্য। উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট আরোপ করতে গিয়ে এখানেও সরকার তার কুৎসিত চেহারা আলগা করেছে। বিপরীতে শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন অন্তত এই আশাবাদের জন্ম দিয়েছে যে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যৌবধর্ম তাদের প্রতিবাদী করেছে।

সরকারি হোক, কিংবা বেসরকারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারের বজ্রমুষ্টি শাসন বজায় রাখতে তাদের চেষ্টায় কোনো খামতি নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শীর্ষ পদে রাষ্ট্রপতির মনোনীত উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের বিধান সে কথাই বলে। কিন্তু ক্ষমতা হাতে রাখলে যে তার দায়ভার নিতে হয়, সেটা তারা ভুলে যান। সম্প্রতি বেসরকারি আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বনির্ধারিত সমাবর্তন শেষ সময়ে বাতিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় দায়িত্বহীনতার চরম প্রকাশ ঘটিয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি এক বছরের বেশি আগে থেকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সম্মতি চেয়ে আচার্যকে চিঠি লিখেছিল। পুরো প্রক্রিয়াটি ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। আবার জুলাই মাসে পূর্বতন উপাচার্যের কার্যমেয়াদ শেষ হবে বিধায় আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন উপাচার্য নিয়োগের জন্য ইউজিসির মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। নতুন কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্যও তারা আবেদন করে। ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় যথাসময়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে এই শীর্ষপদে নিয়োগ দিলে এমন সংকট সৃষ্টিই হতো না।

ইউজিসি ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ইউজিসি এক গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। তাতে মাত্র ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি শীর্ষপদে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োজিত ছিলেন। তাতে অন্য কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বাধ্যতামূলক পদ শূন্য, তা বোঝা যায় না। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সহ-উপাচার্য নিয়োগে আগ্রহী নয়। শীর্ষ প্রশাসনে শাসন-দ্বৈততা ও অতিরিক্ত ব্যয় এড়াতে তারা এটা করে। ইউজিসি সহ-উপাচার্য নিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করেছে কি না, তা জানা যায় না। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সহ-উপাচার্য পদটি খালি রেখে চলছে। কিন্তু একই সঙ্গে উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদ শূন্য থাকার দায় ইউজিসি বা মন্ত্রণালয় এড়াবে কী করে? গত ২২ অক্টোবর ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শীর্ষ তিন পদে জরুরি নিয়োগের আহ্বান জানায়। তাতে উল্লেখ করা হয়, আচার্য কর্তৃক নিয়োগ না পেলে কোনো ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের স্বাক্ষরিত সনদ বৈধ হবে না। ঠিক এই ইস্যুতেই উত্তাল হয়ে ওঠে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় অন্যান্য ন্যায্য দাবি। সেসব দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাত্র চার দিনের ছাত্র বিক্ষোভের মুখে আহছানউল্লার ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কী এমন নজির আছে? বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এত নাটক করতে দিল সরকার? জাহাঙ্গীরনগরের সমস্যা তো সরকারই জিইয়ে রেখেছে। সেখানকার অভিযোগ কিন্তু অনেক বেশি গুরুতর। ছাত্র-শিক্ষক এক কাতারে শামিল হয়ে মাসের পর মাস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ে, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা। তিন দশক ধরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর আদালতের নির্দেশে যে নির্বাচন করল ২৭ বছর পর, তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কলঙ্কতিলক হয়েই রইবে। ভাবতেও কষ্ট হয়, সে কলঙ্ক সৃষ্টি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে নীতিহীন একদল শিক্ষকই।

এটা কল্পনা করা সত্যিই কঠিন, মুক্তচিন্তা চর্চা দূরে থাক, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সংস্কৃতি চর্চা একেবারে তলানিতে। শিক্ষা, মুক্তচিন্তা, সংস্কৃতি চর্চার প্রকট অভাব যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাধারণ চিত্র, সেই দেশ দুনিয়ার সেরা ধনী, নাকি ফকির সে প্রশ্ন অবান্তর হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার কি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখায়নি?

বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার চাবি কিন্তু সরকারের হাতে।

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]