আবরার হত্যার অভিযোগপত্র

মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তারা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছেন, এ জন্য তাঁরা বাহবা পেতে পারেন। গত বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যে ২৫ জনের নামে অভিযোগপত্র পেশ করা হয়েছে, তাঁরা সবাই বুয়েটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের মধ্যে ৪ জন পলাতক এবং বাকি ২১ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। গত ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে খুন হন।

তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শুধু আবরার হত্যার সঙ্গেই জড়িত ছিলেন না; এর আগেও তাঁরা নানা অপরাধমূলক কাজ করেছেন; ক্যাম্পাসে তাঁরা একটা ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, ভিন্নমত প্রকাশ ও র‌্যাগিংয়ের নামে অনেকেই তাঁদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন।

আমরা সন্তোষের সঙ্গে জানাতে চাই যে সরকার মামলাটিকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করায় এবং তদন্তের কাজে কোনো রকম হস্তক্ষেপ না থাকায় দ্রুততম সময়ে তদন্তকাজ শেষ হয়েছে। একই সঙ্গে আশা করতে চাই যে আবরার হত্যার বিচারকাজও দ্রুত শেষ হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, দ্রুত বিচার আইনেই এই মামলার বিচার হবে। সরকার আন্তরিক হলে যে দ্রুত হত্যা মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব, ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলা তার প্রমাণ। হত্যাকাণ্ডের ছয় মাসের মধ্যে ওই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে। দ্রুত তদন্ত শেষ হওয়ায় আবরারের স্বজনেরাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমরা মনে করি, সব হত্যা মামলার ক্ষেত্রেই সরকারের এই অগ্রাধিকার থাকা উচিত। সে ক্ষেত্রে অপরাধীরা যেমন দ্রুতই শাস্তি পাবেন, তেমনি অপরাধের হারও কমবে।

অভিযোগপত্র পেশের পর বুয়েটের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাঁদের তিন দফা দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এর মধ্যে আছে মামলার অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার, বুয়েটের আহসানউল্লাহ, তিতুমীর ও সোহরাওয়ার্দী হলে সংঘটিত র‌্যাগিংয়ের ঘটনাগুলোয় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি, সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি ও র‌্যাগিং বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে বুয়েটের অধ্যাদেশে সংযোজন।

২ নভেম্বর বুয়েটের উপাচার্য সাইফুল ইসলাম, ছাত্রকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক মিজানুর রহমান ও অনুষদগুলোর ডিনদের সঙ্গে বৈঠকের পরও শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, দাবি পূরণ হলে তাঁরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাবেন। আবরার হত্যা মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবি পূরণে আর কোনো বাধা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই বলেছিল, অভিযোগপত্রে যাঁদের নাম আসবে, তাঁদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে। অপর দুটি দাবিও যেহেতু কর্তৃপক্ষ নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিল, সেহেতু ভিন্ন চিন্তার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ সংযোজন ও বিয়োজনের এখতিয়ার সরকারের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সুপারিশ করতে তো কোনো বাধা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীতিগতভাবে শিক্ষার্থীদের যে দাবি মেনে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নে দেরি করার অর্থ অচলাবস্থা জিইয়ে রাখা। বুয়েট কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি বলেই আবরার হত্যার মতো নৃশংস ও বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে। এখন তাঁদের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে অচলাবস্থার অবসান ঘটানো। বুয়েটের মতো দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক দিনও ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকা উচিত নয়।

যে ছাত্ররাজনীতি সহপাঠীর জীবন কেড়ে নেয় কিংবা ছাত্রসংগঠনের নামে ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে, সেই ছাত্ররাজনীতি কোনোভাবেই দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। অতএব, ছাত্ররাজনীতি নিয়েও সরকারের নতুন করে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি।