পাতাঝরার মৌসুম এসে গেছে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রোহিঙ্গা, শুদ্ধি অভিযান, ক্রিকেট—সব ছাপিয়ে পেঁয়াজ এখন সংবাদ শিরোনাম। বাঙালির রাজনীতি-অন্তঃপ্রাণ এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে। গরম খবর যেটুকু হাওয়ায় ভাসছে, তা হলো ছোট দলগুলো আরও ছোট হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, কিংবা এটাই কি অনিবার্য ছিল, 

এ নিয়ে চায়ের কাপে তেমন ঝড় উঠছে না। কিন্তু বিষয়টি ভাবায়।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কত, চটজলদি কেউ বলতে পারবেন না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এর হিসাব থাকতে পারে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। জেলা পর্যায়ে কমিটি আছে, এমন দলের সংখ্যা চার-পাঁচটির বেশি হবে বলে মনে হয় না। তারপরও এসব দল আছে, দলে নেতা আছেন। তাঁরা মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিয়ে বা সংবাদ সম্মেলনে করে জানান দেন, এখনো তাঁরা অস্তে যাননি।

আকাশে অনেক তারা আছে। রাতের অন্ধকারে তারাগুলো মিটমিট করে। যতগুলো দেখা যায়, তারার সংখ্যা আরও বেশি। অনেকগুলোর আলো পৃথিবীতে এখনো এসে পৌঁছায়নি বলে আমরা দেখতে পাই না। এত দূরে যে তাদের আলো ধরাধামে আসতে আরও সময় লাগবে। হিসাবটা আলোকবর্ষের।

মানুষ তো নানা রকম সংগঠন তৈরি করে। সমাজসেবা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, খেলাধুলা—নানান উদ্দেশ্যে ও কাজে মানুষ দল বানায়, দল পাকায়। রাজনৈতিক দল তো এসবের চেয়ে আলাদা। তার কাজ হলো রাষ্ট্র নিয়ে। রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া—একক শক্তিতে কিংবা হিস্যাদার হয়ে। দল যত ছোটই হোক, তার নেতার ইচ্ছা থাকে ক্ষমতার বৃত্তে ঢোকার। অন্দরমহলে না হলেও ক্ষমতার বারান্দায় পায়চারি করার। সে জন্য ছোট দলগুলো নিজেরা একজোট হয়। কখনোবা বড় একটি দলের সঙ্গে জোট বাঁধে। জোটের রাজনীতি এ দেশে অনেক বছর ধরেই চলে আসছে।

বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ছোট দলের এবং জোটের বড় শরিকের ‘ভ্যালু এডিশন’ কী, এ নিয়ে নানান কথা আছে। জীবনভর একা থেকে মিটমিট করে জ্বলার মধ্যে কী ফায়দা এবং উঠতে-বসতে খোঁটা শুনেও বড় দলের সঙ্গে ঘর করার কী মাজেজা, তা মোটামুটি জানা। সবাই সেই হিসাব কষেন। পোষালে জোটে যান, না পোষালে জোট ছাড়েন। এমনকি একটি দলের মধ্যেও নেতাদের মধ্যে ভাগ ভাগ থাকে। কখন আড়ি হয় আর কখন সন্ধি, তারও একটা ফর্মুলা আছে, আছে ব্যাকরণ। তবে এখানে নিয়তি বা ভাগ্যের একটা বড় ভূমিকা থাকে। মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে ‘অদৃষ্টের ফের’ অংশটির কয়েকটি লাইন এখানে উদ্ধৃত করা দরকার মনে করছি।

কুট্টুনি আসিয়া কয় “বড় বাপের ঝি।

পরের লাগ্যা দুঃখু কইরা তোমার হইব কি।।

কাজীর ঘরে গেলে দাঁতে কাট্যা খাইবা সোনা।

উপাস করিয়া কেন হও ক্ষিধায় ফানা।।

এ মুইঠ চাউল নাই ঘরেতে তোমার।

এমন শরীরে দুঃখু কত সহে আর।।

ফিরিয়া পাঠাইল কাজী তোর দোয়ারে।

মরজি করিয়া তুমি সাদি কর তারে।।…”

গীতিকার এই পঙ্‌ক্তিগুলোয় বাঙালি জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। হাল আমলের নাগরিক জীবন থেকে অনেক দূরে অতীতকালের সমাজের চিন্তাভাবনা লোকসাহিত্যে স্থান পেয়েছে। যুগ বদলেছে। লোকসাহিত্যেরও পরিবর্তন ঘটেছে। তবু অতীতের ছবিটি হারিয়ে যায়নি। প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় মৈমনসিংহ গীতিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। আজও তার ছত্রে ছত্রে সমকালীন রাজনীতির মনস্তত্ত্ব ও বৈচিত্র্য প্রকাশ পায়।

উপোস থাকার চেয়ে বড়লোকের সংসারে ঠাঁই পেয়ে দুমুঠো খাবার পেয়ে বর্তে যায় অনেকেই। আবার কারও কারও ইজ্জতের জোর বড্ড বেশি। তাদের কথা—জান দেব তবু মান দেব না। এসব আকর্ষণ-বিকর্ষণ, দ্বন্দ্ব-ভালোবাসা, পাওয়া, না পাওয়ার আনন্দ-বেদনা নিয়েই এ দেশে জোটের রথ ছুটছে। কেউ ছিটকে পড়লে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও কিংবা বড় দলের চোখরাঙানি থাকলেও জোটের জোর পাগলেও বোঝে। কথায় আছে, পাগল হলে কী হবে, পাঁচ টাকার নোট চেনে।

দল তো কোনো স্থবির বস্তু নয়। মানুষ নিয়ে তাদের কারবার। সেখানে টানাপোড়েন লেগেই আছে। এক জোটের কাছে মর্যাদা না পেয়ে অন্য জোটের দুয়ারে ধরনা দেওয়া কিংবা জোট ছেড়ে নিজের পথ নিজেই দেখা অথবা একা থাকার চেয়ে কোনো একটা জোটে ঢুকে পড়া—এ তো হামেশাই হচ্ছে। এ ছাড়া আছে ছোট দলগুলোর নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান, গৃহযুদ্ধ। একসময় মতাদর্শগত সংগ্রাম, দুই লাইনের লড়াই—এই সব শব্দ বেশ চাউর ছিল। এখন এগুলো আর শোনা যায় না। আদর্শ-ফাদর্শ অনেক আগেই জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে। প্রাপ্তিযোগই এখন
মুখ্য ও মোক্ষ। লুই কানের নকশা করা দালানে ঢোকার জন্য কত চেষ্টা, কত আকুতি। সেখানে যাঁরা একবার ঢুকেছেন, তাঁরা বারবার যেতে চান। যাঁরা এখনো ঢোকেননি, তাঁরা ঢোকার জন্য কত না কসরত করছেন।

কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজনীতির ছোট ছোট কুঠুরিগুলোয় কত–কী না ঘটে যাচ্ছে, পেঁয়াজের ঝাঁজে সব যেন ঢাকা পড়ে গেছে। আ স ম আবদুর রবের জেএসডিতে গৃহদাহ শুরু হয়ে গেছে। নাগরিক ঐক্যের ঐক্য নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ২০-দলীয় ঐক্যজোটে ঝরাপাতার মৌসুম প্রায় আগত। সেখানে এলডিপির হাঁকডাক শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ‘ঐক্যফ্রন্ট’ থেকে বেরিয়ে এসে আবদুল কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের নেতার মন পাওয়ার জন্য ঘোরাফেরা করছেন অনেক দিন ধরে। ওয়ার্কার্স পার্টি যাচ্ছে একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে। সেখানেও বিদ্রোহ। দল যত ছোটই হোক না কেন, তারা খবর তৈরি করছে। কথায় আছে, ছোট মরিচের ঝাল বেশি।

বড় দলগুলোও স্বস্তিতে নেই। অঙ্গ কিংবা সহযোগী সংগঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ একটা যন্ত্রণার মধ্যে আছে। ঠগ বাছতে গঁা উজাড় হওয়ার অবস্থা। ঢাকার বাইরে তো দলের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ হচ্ছে। বিষয়টা খুনোখুনিতে গিয়ে ঠেকছে। ডিসেম্বরে দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। অনেক জায়গায় জেলা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। সেখানে সম্মেলন করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় কমিটিতে কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে, কে ভোকাট্টা হবে, তা নিয়ে অনেকেই আশায় কিংবা আতঙ্কে আছেন।

বিএনপির দিকে তাকালে মনে হয়, হেমন্ত এসে গেছে। গাছের পাতা ঝরছে। দল থেকেও কেউ কেউ ঝরে পড়ছেন। অনেকেই ইতিমধ্যে দেয়ালের লেখা পড়ে ফেলেছেন আর ভাবছেন—কী আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে। রবার্ট ব্রুস আর কত প্রণোদনা জুগিয়ে যাবেন। অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে।

তাহলে থাকল কী? মানুষের মনে ক্ষোভ, অভিযোগ। দলে রাজনীতি নেই। সরকারে দল নেই। রাষ্ট্র চলে কীভাবে? তারপরও রাষ্ট্র চলছে। ইতিমধ্যে ঘোষণা হয়ে গেছে—আমরা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার ছেড়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে গেছি। অর্থনীতিতে একটা কথা আছে—সেলফ-সাসটেইনড গ্রোথ। অর্থাৎ আমরা এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে প্রবৃদ্ধির চাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ছুটবে সামনের দিকে। এখন আর রাজনীতি নয়, অর্থনীতিই রাষ্ট্রের চালকের আসনে। তাই রাষ্ট্রও এগোবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আমরা এমন একটা যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে রাজনীতি। রাজনীতি আর কারও ইচ্ছাপূরণের কেচ্ছা হবে না। আমরা চাই বা না চাই, সেটাই কি ঘটছে না?

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
[email protected]