নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম

পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে গেছে অনেক আগেই। সরকার বিদেশ থেকে বিমানে করে পেঁয়াজ আনছে, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ আগেই দেশে পৌঁছেছে—যদিও বাজারে তার প্রভাব তেমন পড়েনি। পেঁয়াজের দাম বাড়ছিল রকেটগতিতে, কমছে ঠেলাগাড়ির গতিতে। এরই মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো চাল, ভোজ্যতেল ও সবজির দামও বাড়ছে। আর আদা-রসুনের দাম কয়েক মাস ধরেই বাড়তির দিকে। বলা যায়, সাধারণ মানুষ বাজারের ক্রমাগত চাপে লবেজান। 

অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে আর সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। কিন্তু বাংলাদেশে সব সময় এই নিয়ম খাটে না। বর্তমানে বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, পেঁয়াজ ছাড়া কোনোটির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। পেঁয়াজের দাম বাড়ার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। সময়মতো বিকল্প বাজার থেকে পেঁয়াজ আনা গেলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তাসাধারণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতে পারতেন না। মন্ত্রী-সাংসদেরা পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য অসাধু ব্যবসায়ী, তথা সিন্ডিকেটকে দায়ী করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিষ্ক্রিয়তা দুর্ভাগ্যজনক। কতিপয় ব্যবসায়ী মিয়ানমার থেকে আনা পেঁয়াজ বাজারে না ছেড়ে গুদামজাত করে রেখেছিলেন। খাতুনগঞ্জ আড়তে রাখা পেঁয়াজে পচন ধরায় ১৫ টন নদীতে ফেলে দিতে হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে গুটিকয়েক ছোট ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও বড় মজুতদারেরা বরাবরের মতো রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই। 

পেঁয়াজের পাশাপাশি চাল, ভোজ্যতেল ও সবজির দামও বাড়ছে, যা সীমিত আয়ের মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু–এক দিনের ব্যবধানে চিকন চালের কেজি ৬-৭ টাকা, মাঝারি চাল ৩-৫ টাকা বেড়ে যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক। অন্যদিকে ভোজ্যতেলও লিটারপ্রতি বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা। আদা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়। রসুন আগে থেকেই বাড়তির দিকে ছিল। সব সবজির দাম চড়া হলেও কৃষক লাভবান হচ্ছেন না। যে শিম ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০ টাকা, সেই শিম যশোরে পাওয়া যায় ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। এর পেছনেও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। 

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চালকলের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে দাম না বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশে চালের যথেষ্ট মজুত আছে। তবে বাংলাদেশের মানুষ এখন বেশি বেশি করে চিকন চালের ভাত খাওয়ায় চিকন চালের দাম বেড়েছে বলে মন্ত্রী তত্ত্ব দিয়েছেন, তা সত্য নয়। শুধু চিকন নয়, সব চালের দামই কমবেশি বেড়েছে। মন্ত্রীর বক্তব্য বাজারে ভুল বার্তা দিতে পারে। এর আগে পেঁয়াজ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বাজারকে অস্থিতিশীল করেছিল। অতীতে দেখা গেছে, কোনো পণ্যের দাম বাড়লে মন্ত্রী-আমলারা ঘন ঘন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন, বাজার তদারকি জোরদার করেন। এবার বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের একবার বৈঠক করেই দায়িত্ব শেষ করেছেন। 

গত কয়েক বছর মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় থাকায় সরকার একধরনের সন্তুষ্টির মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন যেভাবে প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে, তখন আর আগের সন্তুষ্টি নিয়ে আত্মতৃপ্ত থাকার সুযোগ নেই। পণ্যের দাম বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষ তথা নিম্নবিত্ত মানুষই বেশি কষ্ট পায়। তাই বাজার নিয়ে বেশি কথা না বলে মন্ত্রীদের উচিত বাজার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা। কখন কোন পণ্যের সংকট তৈরি হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে পণ্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়া এবং টিসিবি বা খোলাবাজারে বিক্রির মাধ্যমে বাজারে হস্তক্ষেপ করার মতো সামর্থ্য অর্জন করা। তাতে ভোক্তাসাধারণের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।