খেজুরের গুড়ে ভেজাল না দেওয়া

খেজুরগাছের সঙ্গে গাছির গাঁটছড়া বহুকালের। রস-গুড় বেচে যেহেতু গাছির অন্নসংস্থান হয়, সেহেতু গাছই গাছির অন্নদাতা। একটা সময় ছিল যখন শীত নামলে সবাই এই গাছ আর গাছির খোঁজ করত। এখন দিন বদলেছে। খেজুরগাছ কমছে। গাছি কমছে। গাছির সততাও কমছে। গাছিরা এখন যে গুড় বাজারে আনেন, তার বিশুদ্ধতায় ভোক্তা ভরসা পায় না। কারণ, অধিকাংশ গুড়ে থাকে ভেজাল। বিশ্বাসের গুড়ে পড়া ভেজালের বালুতে ভোক্তা প্রতারিত হতে হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। 

আশার কথা, এই অনাস্থার দশা কাটাতে গত বছর এগিয়ে এসেছিলেন যশোরের পাঁচ তরুণ উদ্যোক্তা। তাঁরা গাছিদের মাধ্যমে যশোরের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের নির্ভেজাল রস-গুড়-পাটালি উৎপাদন ও অনলাইনে সারা দেশে তা বিপণন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নিজেদের অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘কেনারহাট ডট কম’-এর মাধ্যমে তাঁরা বিশুদ্ধ গুড় মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসনও তাঁদের পাশে থাকবে বলে তখন জানিয়েছিল। সেই উদ্যোগ এবারও উদ্যোক্তারা ধরে রেখেছেন। প্রশাসনও কথা রেখেছে। গত শনিবার দুপুরে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দরাজ হাট ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ ৬০ জন গাছিকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথবাক্য ছিল এ রকম, ‘যশোর জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়-পাটালি, যা সারা দেশে যশোরকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। যশোরের বিখ্যাত এই খাদ্যপণ্যে আমরা ভেজাল মেশাব না। আজ থেকে এটা আমাদের শপথ।’ ‘কেনারহাট ডট কম’ এই শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। 

এই তরুণ উদ্যোক্তারা ৬০ জন গাছিকে নিয়ে নির্ভেজাল রস-গুড়-পাটালি উৎপাদন করছেন। তাঁদের হাতে উৎপাদিত বিশুদ্ধ গুড়-পাটালি ন্যায্য দামে কিনে তাঁরা অনলাইনের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন। উদ্যোক্তারা বলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য শুধু অর্থ উপার্জন নয়, একটি মহৎ সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাঁরা কাজটি করছেন। তাঁদের এই মহতী উদ্যোগে একাত্মতা ঘোষণা করা গাছিরাও মহৎ সামাজিক দায়বদ্ধতায় ভূমিকা রাখছেন। তাঁদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছেন। এ বড় আনন্দের কথা। 

সাদা চোখে এটিকে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরের একটি সামাজিক উদ্যোগ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই ছোট উদ্যোগের মধ্যে একটি বৃহত্তর সম্ভাবনার ঝিলিক রয়ে গেছে। এই তরুণেরা খেজুরের রস বা গুড়ের বিশুদ্ধতা নিশ্চিতে যে যাত্রা শুরু করলেন, তা অন্যান্য কৃষিজাত ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা যেতে পারে। তাঁদের এই মডেল অনুসরণ করে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, তেল, মসলাসহ নানা ধরনের কৃষিজাত পণ্যের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং এসব পণ্যের বিপণনব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কৃষকের স্বার্থকে অধিকতর সম্পর্কযুক্ত করা গেলে গোটা দেশে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন চলে আসবে। 

সামাজিক ব্যবসার আদলে এভাবে বিপণনব্যবস্থা বিকশিত হলে ভেজাল প্রবণতাও কমে আসবে। সেই ধরনের একটি সোনালি সময় যে এ দেশের বুকে নেমে আসতে পারে, যশোরের পাঁচ তরুণ উদ্যোক্তা সেই আভাস দিয়েছেন।