ইয়েমেনে কি শান্তি আসছে

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সম্প্রতি পরিষ্কার সংকেত দিয়েছে যে তারা ইয়েমেনের দ্বন্দ্ব এবং হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ নিষ্পত্তির জন্য প্রস্তুত। ১০ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ বলেছেন, হুতিরা হচ্ছে ইয়েমেনি সমাজের একটি অংশ এবং দেশটির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা থাকা উচিত। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এডেন থেকে তাদের সর্বশেষ বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার সমর্থনে গারগোশ এ বক্তব্য দেন। আসলে আবুধাবি এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে যে ইয়েমেনের সংঘাতের সামরিক সমাধান হতে পারে না।

সৌদি আরবও হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে ওমানের মধ্যস্থতায় সৌদি কর্মকর্তারা ও হুতি প্রতিনিধিরা পরোক্ষ শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এ ধরনের শান্তি আলোচনা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা বিচার করা খুব কঠিন। কেননা, এর আগে ২০১৬ সালে একই ধরনের আলোচনা শান্তি আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে শান্তি আলোচনা যে হচ্ছে, তা একটি ইতিবাচক লক্ষণ।

সৌদি–হুতি আলোচনা ফলপ্রসূ হলে ইয়েমেনের আজকের ভয়াবহ পরিস্থিতির অবসান ঘটতে পারে। আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের (এসিএলইডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনমতে, ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সশস্ত্র অভিযানের ফলে এক লাখের বেশি ইয়েমেনি মারা গেছে। বিমান হামলার কারণে বেসামরিক নাগরিকদের দুই–তৃতীয়াংশ নিহত হয়েছে। এদিকে একই সময়ে হুতি বিদ্রোহীদের হামলায় হতাহত হয়েছে প্রায় দুই হাজার বেসামরিক মানুষ। এই সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধান না হলে ইয়েমেনে মানবিক বিপর্যয় অব্যাহত থাকবে এবং দেশটি শুধু সৌদি আরবই নয়, পুরো আরব উপদ্বীপের জন্য অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে রয়ে যাবে।

সৌদি আরব দেখেছে যে হুতি বিদ্রোহীদের পরাজিত করা এবং সানায় প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মনসুর হাদির বৈধ কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের প্রচেষ্টা অকার্যকর এবং অবান্তর প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, হাদির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এসটিসি) এবং বিভিন্ন উপজাতি ও আঞ্চলিক গোষ্ঠীর আন্তবিরোধ হুতিদের বিরুদ্ধে লড়াইকে লাইনচ্যুত করেছে। আমিরাতি বাহিনীর হস্তক্ষেপে ২০১৫ সালে দক্ষিণের এডেন শহরটি হুতিদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা হয়; তারা লোহিত সাগর উপকূলে হোদেইদা শহরও পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।

তবে গত জুলাই মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেন থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়, যা পুরো ইয়েমেনি ব্যবস্থাকে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গত আগস্টে এসটিসি এডেন দখল করে, ফলে প্রেসিডেন্ট হাদির অনুগত বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয় এবং হুতিদের বিরুদ্ধে স্থল অভিযানের সব সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।

এদিকে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সদস্য সুদানে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে (যা গত এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে হয়) এবং সেখানে একটি বেসামরিক সরকার গঠনের কারণে ইয়েমেনে যুদ্ধরত প্রায় ১০ হাজার সুদানি সেনাকে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হয়। সুতরাং, এর ফলে বহু প্রয়োজনীয় স্থল অভিযানে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে। গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনায় হামলার ঘটনায় সৌদি নেতাদের মধ্যে এই উপলব্ধি আসে যে এভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিরর্থক। কেননা, চার বছরের বেশি সময় ধরে তারা হুতি বিদ্রোহীদের সামরিক সামর্থ্যে এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি।

বহু বছরের যুদ্ধের পর ইয়েমেনে সত্যিই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কি না, সে বিচার এখন করাটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তবে অতীতের ব্যর্থতাগুলো সমাধানের প্রচেষ্টা একটি উত্সাহব্যঞ্জক লক্ষণ। দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে এখন রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী বলে মনে হচ্ছে। এটি আরও উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা যে সৌদি আরব এখন কেবল আরব উপদ্বীপে ইরানের প্রভাব মোকাবিলার জন্য একটি ক্ষেত্র হিসেবে ইয়েমেনকে দেখার পুরোনো এবং ক্লান্ত নীতিগুলো এড়িয়ে চলতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।

বস্তুত, ইয়েমেনের সমস্যাগুলো ইরানের হস্তক্ষেপের কারণে নয়, বরং সব সময় কর্তৃত্ববাদী শাসন, সুশাসনের অনুপস্থিতি, দুর্নীতি এবং অভিজাত প্রতিযোগিতার কারণে উদ্ভূত হয়েছে। ইরান ইয়েমেনের দৃশ্যপটে একজন নতুন আগন্তুক, যার প্রবেশ হঠাৎ করে নয়, বরং নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। সৌদি আরবের এখন একটি শান্তিচুক্তি করার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, যা ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও তার নিজস্ব স্থিতিশীলতা সুরক্ষিত করবে। ইরানের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অনেক কারণের ওপর নির্ভর করে। সেখানে ইয়েমেনের যুদ্ধ সামান্য একটি অংশ মাত্র।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ইমাদ কে হার্ব : ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারের গবেষক ও বিশ্লেষক